গাইবান্ধা জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগ এর একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। প্রশাসন গাইবান্ধা জেলা ১৮৫৮ সালের ২৭ আগস্ট বৃহত্তর রংপুর জেলার অধীনে ভবানীগঞ্জ নামে একটি মহকুমা গঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে ভবানীগঞ্জ নদীগর্ভে বিলীন হলে মহকুমা সদর দপ্তর গাইবান্ধায় স্থানান্তরিত হয়। এ এলাকা এক সময় বাহরবন্দ পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯২৩ সালে গাইবান্ধা শহরটি মিউনিসিপ্যালিটিতে রূপান্তর হয়। ১৯৬০ সালে মিউনিসিপ্যালিটি বিলুপ্ত হয়ে গাইবান্ধা টাউন কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে শহর এলাকা গাইবান্ধা পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। গাইবান্ধা জেলা গঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। গাইবান্ধা জেলার ৭টি উপজেলা যথাক্রমে (১) সদর (২) সুন্দরগঞ্জ (৩) সাদুল্ল্যাপুর (৪) পলাশবাড়ী (৫) গোবিন্দগঞ্জ (৬) ফুলছড়ি (৭) সাঘাটা উপজেলা। ৮২টি ইউনিয়ন, ১১০১টি মৌজা এবং ৪টি পৌরসভ নিয়ে গঠিত। একটি দেশে পরিবেশ রক্ষায় ২৫ % গাছপালা ও বনভূমি থাকা দরকার। সে তুলনায় গাইবান্ধায় গাছপালা ও বনভূমি ছিল ১৭% বর্তমানে তা ৫%কমে ১২% এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকেও প্রতিনিয়ত শুধু কমছে আর কমছে। আমাদের দেশে বর্তমানে তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। ‘ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না’ বলে প্রবাদও রয়েছে। আর এই তাল গাছই এখন অন্য রকম উপকারে আসছে মানুষের। করছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি রোপণের জন্য ২০১৭ সালে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয় বেশি বেশি তাল গাছ রোপণ করতে। এরপর কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গাইবান্ধায় সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বর্ষা ও সারা বছরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তাল গাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছের মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকর। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আর ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ ধানখেত, মাঝখানে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, তার দুই পাশে মাথা উঁচু তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন সুন্দর ও নৈসর্গিক দৃশ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। তালগাছ স্বল্পতার কারণে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ ও পশুপাখি।
আশ্রয় হিসেবে এ গাছ বাবুই পাখিদের বড়ই প্রিয় জায়গা। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুরসহ নানা প্রাণী আশ্রয় হিসেবে এ গাছটি বেছে নেয়। দেশে তালগাছ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যু বরণ করেছে ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ২৩৬ জন।প্রতি বছর গড়ে ২১৬ জনের বেশি মানুষ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে মৃত্যুবরণ করেছে। আর ২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে ৫৭ জন। ২০২৩ সালে ১৩৫ জন। ২০২৪ সালে সারাদেশে ২৯৭ জন মারা যান।
প্রতি বছর বাংলাদেশে মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এমনকি ঈদের দিন ও বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে অন্তত আট জন মানুষ। সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে চলে যায়। এ ছাড়াও ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুত বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা; ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ।
পরিশেষে, তাল গাছ শুধু বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে না, বরং তাল গাছের নানান উপকারিতা রয়েছে। মানুষ বিভিন্নভাবে তাল গাছ দ্বারা উপকৃত হয়। যেমন: তালপাতার পাটি, তালপাতার পাখা একদা ছিল জনপ্রিয়। তালের রস, তালের গুড়, তালের শাঁস, তালের রস দিয়ে সুস্বাদু মিষ্টি খাবার রান্না করা হয়। তাল দিয়ে ঐতিহ্যবাহী অনেক পিঠা তৈরি করা হয়। তালের গাছ ও পাতা ঘরের কাজে এবং জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়। তালের পাতায় সুন্দরভাবে বাসা তৈরি করে সেখানে পাখি বসবাস করে। তালগাছ মানুষ ও পাখি উভয়ের জন্যই উপকারী। রাস্তার দুপাশে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত জায়গায় তালবীজ বপন করা যায়। সবাইকে সচেতন করে তালবীজ বপনে উদ্যোগী করে তুললে মানুষসহ পশুপাখি বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আর বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তাল গাছের বিকল্প নেই। বেশি করে তাল গাছ লাগালে, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমবে। গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে তাল গাছের পরিকল্পিত করলে নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি হবে। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ কামদিয়া রোডের প্রচুর পরিমাণে তালগাছ রয়েছে। সেখানে সারি সারি তালগাছ দেখতে দূর দুরান্ত থেকে পর্যটক ছুটে আসে। গাইবান্ধা জেলায় প্রবেশদ্বার বলা হয় পলাশবাড়ী উপজেলাকে। পলাশবাড়ী উপজেলা থেকে আসতে অসংখ্য রোপিত তালগাছ চোখে পড়ছে।কিন্তু তালগাছ গুলো বড় না হতেই এমনভাবে ডাল গুলো ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে বা ডালপালা গুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী রাস্তার তালগাছ গুলো কিছু দিনের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তালগাছ গুলো বিলুপ্ত হলে গাইবান্ধা জেলার পরিবেশের উপরে বিরুপ প্রভাব পড়বে নানান ভাবে। তালগাছগুলো রক্ষায় এখনই যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
আপনার মতামত লিখুন :