“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড” কিন্তু আমরা জানি, পুষ্টিহীন মেরুদণ্ড জীবনের কোনো কাজে তো লাগেই না; বরং তা আরও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি পুষ্টির মতো মানসম্মত শিক্ষার জোগান না দেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ঘুষ, দূর্নীতি আর রাহাজানির এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে যা রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য বিপদ সংকেতের ঘণ্টা বাজিয়ে ছাড়বে। জাতির অধঃপতনে প্রত্যেক বাঙালি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যে, মানসম্মত শিক্ষার বড়ই অভাব। মানসম্মত শিক্ষা কি সেটাই, যেটা ক্লাসে শিক্ষকগণ পড়াবেন আর শিক্ষার্থীরা তোতাপাখির মত আওড়াবেন, গলাধঃকরণ করবেন সবশেষে পরীক্ষার খাতায় ঢালবেন আবার ভুলে যাবেন? নিশ্চয়ই এমনটা নয়। মানসম্মত শিক্ষা তো সেটাই যেটা একটা প্রত্যয়ী, উদ্যমী এবং পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী তৈরীর নিশ্চয়তা প্রদান করে।
প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী হবে সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পারদর্শী এবং যারা সৃষ্টিশীল কাজে নিজের প্রতিভাকে ফুটিয়ে তুলবে আবার অন্তরে থাকবে এমন প্রত্যয় যা কোন কিছু করতে হার না মানা মনোভাবকে ব্যক্ত করবে। আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু মানসম্মত? এই প্রশ্নের জবাবে একেবারে না বলা কষ্টকর তবে কতটুকু হ্যাঁ বলা যাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
প্রবাদে আছে “গাছে কাঁঠাল আর গোঁফে তেল” আগে তো কাঁঠাল ঠিকমতো পাকতে হবে তারপর নিজের আয়ত্তে নিতে হবে তবেই না তেল দিলে লভ্যাংশ অর্জন সম্ভব। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না করেই মানসম্মত শিক্ষা! দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে বসে ক্লাস করে। নেই বসার মতো ভালো বেঞ্চ, নেই ভালো কোনো আসবাব। ক্লাসরুমগুলো ছোট্ট ছোট্ট, তার উপর আবার গাদাগাদি করে বসা।
মানসম্মত শিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য করা। দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কিছু প্রতিষ্ঠানে তো গ্রন্থাগার না-ই আবার যেগুলোতে আছে সেগুলোরও করুণ অবস্থা।
গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দেয়া হলেও শিক্ষক সংকটের কারণে তাদেরকেও ক্লাস দেওয়া হয়, যা গ্রন্থাগার কার্যক্রম এর বেহাল দশাই ফুটিয়ে তুলে। আবার হাতে কলমে শিক্ষার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও ল্যাবের সামগ্রী আলমারির গহীন কোনো এক কোনায় অযত্নে পড়ে থাকে। এই তো গেলো অবকাঠামোগত সমস্যা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা চাই কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার কারিগর শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে অপারগ।
দেশের মেরুদণ্ড ঠিক করা যাদের দায়িত্বে তাদের কি না নায্য দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। একটা জাতির জন্য এর চাইতে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে। কাজী কাদের নওয়াজ রচিত শিক্ষাগুরু মর্যাদা কবিতা পাঠে সবার হৃদয়ে সহানুভূতির জন্ম নেয়, আবার গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পিতৃতুল্য শিক্ষকগণের বিচার করে জুতার মালা গলায় দিতে দ্বিধা করেনা। এ কেমন শিক্ষাগুরুর মর্যাদা! শিক্ষক পদত্যাগের নামে শিক্ষার্থীরা যে আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তাতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, মানসম্মত শিক্ষার সাথে সাথে আমাদের ছেলে মেয়েদের আদর্শ শিক্ষাও আজ তলানিতে।
শিক্ষকগণ একটি জাতির কান্ডারি। তাঁরা তিল তিল করে নীরবে-নিভৃতে জাতীয় আকাঙ্খার প্রতীক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলেন। অথচ এত বড় মাপের মানুষকে নিয়োগের সময় ঘুষ, হয়রানি আর পেরেশানি করতে একদম পিছপা করা হয় না। নিয়োগের পর এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ যে বেতনভাতা পান তাতে কি শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব? চর্যাপদের সেই বিখ্যাত ছন্দ "হাড়িত ভাত নাহি নীতি আবেশী" (হাড়িতে আমার ভাত নেই তাই প্রতিদিন উপোস করে থাকতে হয় অথচ নিত্য অতিথি আসে)। একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষককে ক্লাসে পাঠদানের বাইরে গিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নিতে হয় যা মানসম্মত শিক্ষার প্রধান অন্তরায়।
প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁদের পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রায় ১৫ লাখের মতো। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের নিরলস পরিশ্রমের প্রায় ৯৭ ভাগ অবদান আছে। অথচ যাঁদের যাপিত জীবনের বিরাট অংশজুড়ে লেগে আছে আর্থিক অনটন আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা।
বিখ্যাত মনীষী -এ. পি. জে. আবদুল কালামের উক্তি স্মরণীয়, যদি কোনো দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে, যারা পরিবর্তন আনতে পারেন। তারা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক।"
হে জাতির উন্নতিকামী বন্ধুগণ, শিক্ষকদের দ্বারাই যদি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড শক্তিশালী হয়, দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় তাহলে তাদের নায্য পাওনা পরিশোধ করতে কেন আমরা বদ্ধপরিকর নই? কেন যুগ যুগ ধরে চলা এ বৈষম্যের কোন সুরাহা হচ্ছে না? তাহলে কি আমরা চাচ্ছি যে রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডে পচন ধরুক!
দেশকে সংস্কারসহ মানসম্মত শিক্ষায় উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে আজই শিক্ষক বান্ধব এবং যুগোপযোগী টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। এ বিবেচনায় শিক্ষকদের আর্থিক বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া এবং এগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য ।
লেখক: মো. ইউনুস আলী
শিক্ষক, গহেলাপুর নবাব মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়
রাণীনগর, নওগাঁ।
আপনার মতামত লিখুন :