Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পথশিশুদের রক্ষার্থে এগিয়ে আসুন


দৈনিক পরিবার | মো. ইউনুস আলী অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০৫:৫৬ পিএম পথশিশুদের রক্ষার্থে এগিয়ে আসুন

আমার মা আছে বাবা নেই। মা থেকেও নেই। বাবার মত কাউকে দেখলে বাবার আদরের কথা মনে পড়ে। মন চাইলে কাউকে যদি 'আব্বু' ডাকি তখন বলে, ফকিন্নির পোলা তোর বাপ কে? চিনোস আমারে, আমারে 'আব্বু' ডাকতাছোস ক্যান? এখান থেকে চলে যা, আমাদের চড় মারে, আমাদের কষ্ট লাগে, আমরা কান্দি, আমাদের খাওনও জুটে না। এভাবেই বলছিল আব্দুল্লাহ নামের এক পথশিশু।
বাবা / মা অথবা দুজনকেই হারিয়ে এরকম হাজারো আব্দুল্লাাহ আজ ফুটপাতে, গলিতে, রেলওয়ে বা বাস স্টেশনে নিজেকে আবিষ্কার করে পথশিশু রূপে। চরম দারিদ্রতা, বিবাহবিচ্ছেদ, নদীভাঙন, ভূমিহীনতা অথবা সামাজিক বিভিন্ন দুষ্টচক্রের কারণে যখন মানব শিশুকে পারিবারিক পরিচয় ছেড়ে অন্য কোন পরিচয়ে বড় হতে হয় তখন তাদের আমরা নাম দিই পথশিশু।
শিশু শব্দটি মনেই মহাবিশ্বের যেকোনো প্রাণীর কাছে মায়ের মায়া-মমতা, ভালোবাসা, স্নেহ আর কোমল এক স্পর্শকে বোঝায় যার সংজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ করা অসম্ভব। সৃষ্টির সেরা মাখলুকাত অযত্নের স্বীকার মানব শিশুকে যখন রাস্তার ছেলে, পথশিশু বা টোকাই বলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয় তখন মানবতা আর মনুষ্যত্ব বিবেক থেকে কত দূর হারিয়ে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 
আমরা কেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুককে পথশিশু বলবো, কেন স্রষ্টার তৈরি সর্বোত্তম জীব রাস্তায় থাকবে এর কোন সদুত্তর আছে কি? রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব আর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা বিবেকবান মানুষ এদেরকে সরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হইনি। আমরা তাদেরকে চড়-থাপ্পর, ঘুষি, বাবা-মা তুলে গালি দেওয়াসহ রাজনৈতিকভাবে বলির পাঁঠা বানাতে একদমই দ্বিধা করি না। কি অপরাধ তাদের? শুধু চরম দরিদ্রতা আর জীর্ণদশার কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরেই তাদের হেয়, তিরস্কার আর অবহেলা করার অধিকার কি আমরা প্রতিষ্ঠা করছি? স্মরণীয় যে, আজ পর্যন্ত কোন সভ্য সমাজই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়নি।
দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে, বাবা মা বিচ্ছিন্ন এসব শিশুরা জানে না আগামী দিনে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। অসচেতনতা, অজ্ঞতা, মূর্খতা আর দুষ্টু লোকের শয়তানি চক্র শিশুদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। পথশিশুরা মাদক, জুয়া, চুরি-ডাকাতি, কিশোর গ্যাং নামক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে হরহামেশা জড়িয়ে যাচ্ছে। ছিনতাই, রাহাজানি, চোরাকারবারি, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্যক্রম পথশিশুদের কাছে নিত্যদিনের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা একদম শিশু অবস্থাতেই টলুইন, বেনজিন, অ্যাসিটন ও কার্বন ডাই ক্লোরাইড মিশ্রিত বিভিন্ন গাম নেশার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করতেছে। সর্বনাশা মাদকের ছোবলে পূর্বে পথশিশুরা আক্রান্ত থাকলেও বর্তমানে ধনীর দুলালরাও এসব নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজব্যবস্থায় আস্তে আস্তে ভঙ্গুরতা হানা দিচ্ছে। মস্তিষ্কের কাজে অস্বাভাবিকতাসহ দেখা দিচ্ছে নানা দুরারোগ্য ব্যাধি। 
সমান সুযোগ সুবিধা পাবার অধিকার থাকলেও বাস্তবে এই শিশুরা কতটুকু পাচ্ছে? রাতের বেলা একটু শান্তির ঘুম যেন তাদের জন্য পরম পাওয়া। রাতের ঠান্ডা বাতাস আর মশার কামড়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য হয়ে যায় কষ্টকর। রাত মানেই যেন মেয়ে শিশুদের জন্য এক বিভীষিকাময় চিত্র। তাদের চাহনি আর মায়াবী চেহারা আমাদের এই আধুনিক সভ্য সমাজের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তারা কি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হতে পারে না? পেতে কি পারেনা মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার মৌলিক অধিকারগুলো?
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এর মতে, বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা তা তাদের জানা নেই। এই শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘর থেক বঞ্চিত। শিশুদের সহিংসতার প্রতি তিনটি ঘটনার একটি (৩০ দশমিক ৪ শতাংশ) রাতে তাদের ঘুমের সময় ঘটে থাকে।
শিশুরাই দেশ জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর মূল চালিকাশক্তি আজকের শিশুরা। কৈশোর একটি নাজুক সময়। তাদের দেখভাল করা, ভুল সংশোধন করে দেবার কাজ অতি সহজ নয়। উপদেশের পাশাপাশি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। "জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো" এই উক্তিকে সামনে রেখে আমরা সমাজের বা রাষ্ট্রের যারা সামর্থ্যবান মানুষ তারা অন্তত একজন পথশিশুর দায়িত্ব নিই যাতে সে তার শ্রেষ্ঠ কর্ম পৃথিবীর মানুষকে উপহার দিয়ে মানব সমাজে চিরকাল অমর হয়ে থাকতে পারে।
সামাজিক উন্নয়নে, সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু সুন্দর রাখতে পথশিশুদের পুনর্বাসন একান্তই জরুরী। এ লক্ষ্যে সরকারসহ, বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে গ্রাম-শহরের ওয়ার্ড ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী। শিশুদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে তাদেরকে দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটাতে পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষা নীতির আওতায় এনে শীঘ্রই এসব শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে আগামী দিনে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছে সুশীল সমাজ।
মো. ইউনুস আলী 
শিক্ষক 
গহেলাপুর নবাব মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়
রাণীনগর, নওগাঁ।

Side banner