Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

উৎসবমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন ও দর্শন


দৈনিক পরিবার | শাহিন নুরী অক্টোবর ১০, ২০২৪, ০২:০০ পিএম উৎসবমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন ও দর্শন

বাংলাদেশে বসবাসরত সকল মানুষই হচ্ছে বাঙালি যেকোনো দুর্যোগ যেকোনো সমস্যায় ধর্মবর্ণ শ্রেণী পেশার সকল মানুষ একত্রে মিলবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।  ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল তারপর ২০২৪ এর ৫ আগস্ট কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনার দেশ। আর বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উৎসবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে উৎসব পালন করে।
বাংলাদেশে সনাতনী সম্প্রদায় তাদের চেতনায় তাদের বিশ্বাসে তাদের ধর্ম পালন করে, পূজা পার্বণের মধ্য দিয়ে। তারা হচ্ছেন সনাতন ধর্মালম্বী (হিন্দু)। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আগমনের বার্তা শুরু হয়। দেবী দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শরৎকালে পূজা শুরু হয়। এবছর ৯ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখে পঞ্জিকা মতে ভোরবেলা থেকে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন সহ সর্বস্তরের পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে বাংলাদেশের শারদীয় দুর্গাপূজা যাতে নির্বিঘ্নে হয়, সেজন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিজিবি,  র‌্যাব, পুলিশ, ব্যাটালিয়ান, আনসার, গ্রাম পুলিশ নিযুক্ত করেছে। সেইসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন সহ ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব প্রদান করেছে। শারদীয় দুর্গাপূজায় সনাতনীরা বিশ্বাস করেন প্রতিবছর দুর্গা মা তাদের পৃথিবীর যত অকল্যাণ আছে তা বিনাশ করার জন্য আবির্ভাব হয়। তাই তারা পূজা মন্ডপে মন্ডপে গিয়ে প্রণাম  ভক্তি করে প্রসাদ বিতরণ করে।
প্রত্যেকটি ধর্মের কিছু দার্শনিক দর্শন রয়েছে সনাতন ধর্ম সে দিক দিয়ে পিছিয়ে নয়। পূজা মন্ডপে গিয়ে প্রণাম ও ভক্তি করলে ধর্ম কর্ম ও দায়িত্ব শেষ হয় না। দেবী দুর্গা যেমন অসুর শক্তি তথা পশু শক্তির সাথে আপোষ না করে যুদ্ধ করে অসুর শক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। তেমনি ভাবে সনাতন ধর্ম পালনকারী সকলের দায়িত্ব  হচ্ছে দেবী দুর্গাকে অনুসরণ করা ও অসুর শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অসুর শক্তিকে পরাজিত তথা ধ্বংস করে মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। দেবী দুর্গার মূল দর্শন হলো দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। হিন্দু ধর্মের উপাক্ষান মোতাবেক পৃথিবীতে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য এ পৃথিবীতে দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল। দুর্গতি নাশ থেখে দুর্গা শব্দের উৎপত্তি। 
মানুষের মধ্যে দুইটি শক্তি পাশাপাশি অবস্থান করে।একটি মনুষ্যত্ব অপরটি হচ্ছে পশুত্ব।  মনুষ্যত্বের প্রতীকঃ- বিদ্যা, বুদ্ধি, ভদ্রতা, সততা, শিষ্টাচার, মানবতা, পরপোকার , ক্ষমা, সৎ চিন্তা, সৎ আচরণ, সৎ উপদেশ, সৎ জীবনযাপন ইত্যাদি সহ সকল গুনাবলী সমূহ মনুষ্যত্বের প্রতীক। 
পশুত্বের প্রতীকঃ- লোভ, হিংসা, অহংকার, কাম, ক্রোধ, মোহ, ছল চাতুরী, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন সহ মনের মধ্যে বিদ্যমান খারাপ দিক গুলো পশুত্বের প্রতীক। 
অসুর শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পূর্বে মানুষের মধ্যে যে পশুশক্তি অবস্থান করে উহাকে সর্বপ্রথম বলি/বিসর্জন বা ধ্বংস করতে হবে।এভাবে সবাই যদি মনের মধ্যে যে পশু অবস্থান  করে উহা ধ্বংস করে, তাহলে মানব সমাজে শান্তি বিরাজ করবে।দেবী দুর্গার আগমন উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইরা সবাই মিলে লোভ, হিংসা, অহংকার, কাম, ক্রোধ,  মদ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস , নারী নির্যাতন  ইত্যাদি সহ সকল  অন্যায় কাজ গুলো বর্জন ও উহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পশু শক্তিকে পরাজিত করলে মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।  সবাই মিলে দেবী দুর্গাকে অনুসরন করে পশুত্বকে বর্জন করে মনুষত্বকে সবার উপর স্তান দিয়ে সোনার মানুষ তৈরি করি। সর্ব প্রথম নিজের ঘর থেকে নিজেদের ছেলে, মেয়ে, ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজন ইত্যাদির প্রতি নজর রাখি, তারা যেনো মানুষের মধ্যে বিদ্যমান  খারাপ দিক  তথা পশুত্বকে বর্জন করে ভালো গুনাবলী সম্পন্ন  সোনার মানুষ হতে পারে এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারে।
সত্য, সেবা, নীতি,ধর্ম মানুষের এই চারী কর্ম।আমরা সবাই যেনো যে যার ধর্ম সঠিক ভাবে পালন করি এবং সে ধর্ম পালন যেনো লোক দেখানো না হয়। অন্য কেউ  আপনার প্রতি যে আচরণ বা কথা বললে আপনি অসহিষ্ণু বা বিরক্ত হবেন, সে ধরনের আচরণ বা কাজ অন্যের প্রতি না করাই হচ্ছে সকল ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি। আসুন সবাই মিলে দেবী দুর্গার আগমনকে স্বাগতম  জানাই এবং ন্যায় নীতির ব্যাপারে কারো সাথে আপোষ না করে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,  খ্রিস্টান সহ অন্যান্ন জাতি ও উপজাতি সবাই মিলে-মিশে সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে থেকে একসঙ্গে বসবাস করি এবং অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ না করে যে যার ধর্ম স্বাধীন ভাবে পালন করি।  মাদক মুক্ত, সন্ত্রাস মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত   সমাজ,দেশ তথা শান্তিপূর্ন পৃথিবী গঠন করি। সনাতন ধর্মের সকলে মন্ডপে উপস্থিত হয়ে প্রণাম ও ভক্তি করে পূজা মন্ডপেই দেবী দুর্গাকে সাক্ষী রেখে শপথ পূর্বক বলুন আমাদের মনের মধ্যে বিরাজমান  পশুত্বকে হত্যা করলাম।আজ থেকে আমি লোভ, হিংসা, অহংকার করব না,মিথ্যা কথা বলব না,দূর্নীতি করব না,অন্যের সম্পদ হরণ করব না,নারী নির্যাতন করব না, মাদক সেবন করব না এবং যেকোনো অবৈধ কাজ সহ অন্যের অধিকারে এবং অন্যর ধর্মে হস্তক্ষেপ করব না। তৎসঙ্গে প্রতিজ্ঞা পূর্বক বলছি সর্বদা সত্য কথা বলব,সৎ উপদেশ দিব, সৎ চিন্তা করব, সৎ আচরণ করব, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করব, ক্ষুধার্তকে অন্ন দিব, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করব এবং সৎ জীবন যাপন করব।" সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।"
দুর্গা পূজা এর সূচনাঃ-
সনাতন ধর্মীয় মিথ অনুষারে দুর্গা ছিলো বসন্তকালের পূজা।হিন্দুরা প্রায় ৫০০ বৎসর থেকে শরৎ কালে এ পূজা করে আসছে।অযোদ্ধার রাজা ছিল দশরথ।তার ছিল তিন রানী যথা কৌশল্যা,  কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। কথিত আছে দেবতার আশীর্বাদক্রমে কৌশল্যার গর্ভে রামচন্দ্র, কৈকেয়ী এর গর্ভে ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন জন্ম গ্রহন করেন। রানী কৈকেয়ীর কুপরামর্শ রাজা দশরথ তাকে দুটি বর দেন। প্রথম বর হলো ভরতকে অযোদ্ধার রাজা বানাতে হবে এবং দ্বিতীয় বর হলো রামচন্দ্রকে সপরিবারে বনবাসে পাঠাতে হবে। রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠানোর পর রাজা দশরথ পুত্র শোকে ছয় দিনের মধ্যে মৃত বরন করেন। রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে লঙ্কাধিপতি রাবন সীতাকে হরন করেন।সীতাকে উদ্ধারের জন্য ব্রহ্মার পরামর্শে শিবের স্ত্রী পার্বতীর পূজা করেন বসন্ত কালের স্থলে শরৎকালে।যাকে বলে অকাল বোধন। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা রামচন্দ্র কে অনুসরণ করে শরৎ কালে দুর্গাপূজা করে থাকেন। দুর্গা পূজা  হিন্দুদের একটি যাক জমক পূর্ণ উৎসব। 
৭মী, ৮মী ও সন্ধী পূজা করেও দেবীর আবির্ভাব না ঘটলে রামচন্দ্র ১০৮ টি নীলপদ্ম যোগার করে মহা নবমী পূজার আয়োজন করেন। কিন্তু মহামায়া একটি নীলপদ্ম চুরি করলে বাধ্য হয়ে রামচন্দ্র তার নিজের একটি চোখ উঠিয়ে পূজা শুরু করলে দেবী দুর্গা খুশী হয়ে রামচন্দ্রকে বর দেন।সে বর প্রাপ্ত হয়ে প্রচন্ড যুদ্ধের পর শ্রী রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে নীলমনি ঠাকুরের আমলে দুর্গা পূজা কলিকাতায় শুরু হয় এবং তা ছিলো রাজসিক।পরবর্তীতে তা সার্বজনীন পূজার রুপ নেয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার ভাইয়েরা ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহন করেন এবং ব্রাহ্ম ধর্মের লোকেরা ছিল মূর্তি পূজা বিরোধী। তারা ছিলেন একেশ্বর বাদে বিশ্বাসী। বর্তমানে অনেক হিন্দু মূর্তি পূজা বিশ্বাস করেন না। অনেক হিন্দু মূর্তি পূজা বিরোধী এবং বর্তমানে মূর্তি পূজা বিরোধী হিন্দুদের সংখ্যাটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 
উল্লেখ্য যে রামায়ন প্রায় ৩৮টি ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে। বাল্মিকীর রামায়নকে ভগবান রামচন্দ্রের জীবনী বলে মনে করা হয়।কিন্তু অপর ৩৮ টি ভাষায় অনুবাদিত রামায়ণে রামচন্দ্রের পূজা করার কোন ঘটনার উল্লেখ নাই। পশ্চিম বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী রামচন্দ্রের এ উপক্ষান বিশ্বাস করতেন না। তার মতে অযোধ্যায় রামচন্দ্র নামক কেউ জন্মগ্রহণ করেন নাই। তবে কালের ক্রমে চলে আসা সনাতন ধর্মের সবচেয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা সনাতনীরা তাদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস এবং ধর্মভীরুতার কারণে পূজা অর্চনা করে। ব্যয় সাধ্য করেও প্রতিমা তৈরি করে  মন্ডপে মন্ডপে শারদীয় দুর্গা পূজা উৎসব পালন করে। বাংলাদেশ সম্প্রীতির বন্ধনের দেশ এদেশে নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে যার যার যে ধর্ম সেটি পালন করতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। রাষ্ট্রসংস্কারের ক্ষেত্রে কোন ধর্ম, বর্ণ, জাত এর বিভেদ নেই  তখন একটাই পরিচয় আমরা মানুষ, আমরা বাঙালি, আমরা এ দেশের নাগরিক।

Side banner