Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগের অজানা ভবিষ্যৎ


দৈনিক পরিবার | মোঃ জিলহাজ হাওলাদার আগস্ট ২৫, ২০২৪, ০৭:২৫ পিএম বাংলাদেশ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগের অজানা ভবিষ্যৎ

সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আমজনতার একদফা দাবীতে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের একদফা দাবী আদায়ে 'লংমার্চ টু ঢাকা' কর্মসুচী রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে। ৫ই আগষ্ট গণভবন ঘেরাও করে ছাত্র জনতা। এদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে ড. ইউনুছের অন্তর্র্বতী কালীন সরকারের অভ্যুত্থান ঘটে। শুরু হয় বাংলার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়। শুরু থেকেই ড. ইউনূসের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেমনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এতোদিন সরকার বিরোধী আন্দোলন করে আসা দলগুলো নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। এ বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে ছাত্রসমাজ। তবে নেতা-কর্মীরা একে বর্ণনা করছেন ‘সুসময়’ হিসেবে। মামলার ভয় নেই, কর্মসূচিতে সরকারের পোষ্য পুলিশ বাহিনীর বাধা নেই, নেই গ্রেফতারের ঝুঁকি। ফলে দলগুলোও এখন নতুন মেজাজে রাজনীতির মাঠে নেমেছে। বিএনপি চেষ্টা করছে, দেশব্যাপী দল গুছিয়ে নির্বাচনের জন্য নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত করতে। ইতোমধ্যে স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ হিসেবে স্থান পেয়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। অন্যদিকে জামায়াত চেষ্টা করছে ছাত্র আন্দোলনে আহত-নিহতদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কর্মসূচি দিয়ে ‘জনসম্পৃক্ততা’ বাড়াতে। এমন সময়ে প্রাতৃকিত বিপর্যয় বন্যা দেশের রাজনীতিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দলীয় নেতাকর্মীরা বন্যার্থদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য সহযোগিতা করে জনগণের ইমেজকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। একইসাথে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার এবং নির্বাচন নিয়েও নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে শুরুতেই রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ‘যৌক্তিক সময়’ দেয়ার কথা বলেছে।
তবে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, অন্তবর্তীকালীন সরকার কতদিনে, কী কী সংস্কার করবে তার একটা রূপরেখা খুব দ্রুতই দেয়া উচিত। কিন্তু বিএনপি চায় নির্বাচনের জন্য দলকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার রাজপথে প্রথম বড় ধরনের যে শোডাউন হয়, সেটা করে বিএনপি। সরকার পতনের একদিন পর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশে অংশ নেন দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী। বিএনপি'র অঙ্গ-সংগঠনগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো এবং আন্দোলনে আহত-নিহতদের দেখতে যাওয়ার মতো রুটিন কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে বিএনপি’র রাজনৈতিক কার্যক্রম। এছাড়া এ দলটিকে বড় কোন কর্মসূচি করতে যায়নি। তবে ইতোমধ্যে স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে রদবদল সহ মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি গঠনের কাজ করছে। দলটির কারাবন্দী বহু নেতা কারামুক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। দলের নেতা-কর্মীদের নামে থাকা মামলা কীভাবে প্রত্যাহার হবে সে বিষয়েও কাজ করছে বিএনপি। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, নেতা-কর্মীদের নামে যে মামলা আছে সেগুলোর সমাধান করে সাংগঠনিক দিক দিয়ে একটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে দলের ভেতরে। তিনি আরো বলেন,“পনেরো বছর ধরে আমরা আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনে আটশত নেতাকর্মী গুম হয়েছে। হাজার হাজার হত্যা হয়েছে। প্রায় ষাট লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার।'' বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আরো বলেন, ''আমাদের চেয়ারপারসনকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছিলো। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এখনও দেশের বাইরে। এই বিষয়গুলোকে এখন আমাদের স্বাভাববিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। সে লক্ষে দল কাজ করছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলাগুলো আইনিভাবে মোকাবেলা করেই আমরা তাকে ফেরাতে পারবো বলে আশাবাদী।” মির্জা আলমগীর বলছেন, তাদের লক্ষ্য এখন আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। আমাদের নিজেদের দলকে আগামী নির্বাচনের জন্য যেন আমরা জনগণের সমর্থন নিতে পারি, সে লক্ষ্যে সংগঠনকে তৈরি করা-এটা এখন আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ। সেটা আমরা শুরু করেছি। ‘গায়েবি মামলাসহ’ যেসব মামলা আছে সেগুলো আইনগতভাবে প্রত্যাহারে আলাদা টিম করে দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে।” বিএনপির পক্ষ থেকে শুরুতে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করা হলেও এখন আর নির্দিষ্ট কোন সময়সীমার কথা বলছে না দলটি। বরং অন্তর্র্বতী সরকারের রোডম্যাপ কী হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার হতে চাই দলটি। বিএনপি এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছে; এক. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। দুই. প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সংস্কার। তিন. সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। চার. অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা। বিএনপি বলছে, এসব বিষয়ে সরকারকে দ্রুত কাজ করতে হবে। এনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আমরা প্রথমে বলেছিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন। কিন্তু পরে যখন আমরা বাস্তবতা লক্ষ্য করেছি এত স্বল্প সময় সম্ভব নয়। তাদেরকে অবশ্যই কিছু সময় দেয়া দরকার। একটা যৌক্তিক সময় অবশ্যই তাদের দিতে হবে এসব কাজ করার জন্য।” অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিয়ে এই সময়ের মধ্যে দলের পূর্ণগঠন, মামলা প্রত্যাহার এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরে আনতে চায় বিএনপি। ৫ই আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের নিষিদ্ধ ঘোষিত দল জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা ব্যাপক সারা ফেলেছে দলটিতে। বিএনপির মতো জামায়াতও চায় অন্তর্র্বতীকালীন সরকার যেন প্রশাসন, বিচারবিভাগ এবং অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নেয়। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উপরও জোর দিচ্ছে জামায়াত। বলছে নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে পুনর্গঠনের কথা। এছাড়া সরকার পতনের আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় আইনি বিচারের উপরও গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, "জামায়াত অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের অ্যাকশন (কাজ) দেখতে চায়। ফ্যাসিবাদ সরকার পতন আন্দোলনে জামায়াত ‘পূর্ণশক্তি’ নিয়েই অংশ নিয়েছিলো। সুতরাং ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে’ সরকার জামায়াতের ‘পাওনা’ খুব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেবে। যারা ব্যক্তগিতভাবে অপরাধ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তারা অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত।" তিনি বলেন, " আওয়ামী লীগ দল হিসেবে পুরো দলটাই হত্যায় শরীক হয়ে গিয়েছিলো। আওয়ামী লীগের এক মন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রদের আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? একটা দল পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিলো সন্ত্রাস করার এবং সেটিই হলো। অনেক প্রাণ ঝরে গেলো। সন্ত্রাসীদেরকে যখন বাহিনী হিসেবে দলীয় ব্যানারে নামিয়ে দেয়া হল তখন বিশ্বের বহু দেশে এমন নজীর আছে যে, এমন গণহত্যা যারা করে, তাদের আর সেদেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকে না।” তবে জামায়াতের আমীর জানিয়েছেন, তারা এখনও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানাননি। এ বিষয়ে দলে কোন সিদ্ধান্তও হয়নি বলে নিশ্চিত করেন শফিকুর রহমান।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অতীতের আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে বিভিন্ন দল এবং জোট যুগপৎ আন্দোলন করেছে। এসব আন্দোলনে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র সংস্কারের নানা রূপরেখা দেয়া হয়েছে দলগুলোর পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন যখন সংস্কারের সুযোগ এসেছে তখন এসব দলগুলোর মধ্যে বড় দুটি দল বিএনপি ও জামায়াত তাদের অবস্থান পরিস্কার করেছে। তারা চায়, সংস্কারের কাজে ‘যৌক্তিক সময়’ নিক ড. ইউনূসের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। তবে অতীতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে সফল হতে হলে সবার আগে তারা কী কী সংস্কারে হাত দেবে, সেটার রূপরেখা দরকার। তিনি বলেন,“এখানে একটা আস্থার সম্পর্ক দরকার। তিনি আরো বলেন, উপদেষ্টাগণ কোন কাজগুলোতে প্রাথমিকভাবে হাত দেবে, কতদিন সময় লাগতে পারে, কী কী করবে সেসব বিষয়ে তাদের জনগণকে পরিষ্কার ধারণা দেয়া উচিত। এ বিষয়ে আলোচনার ভিত্তিতে তারা যদি একটা রোডম্যাপ দিয়ে দেয় তাহলে দলগুলোর মধ্যে কোন প্রশ্ন বা অনিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ সব দলই চায় সংস্কার এবং একইসঙ্গে নিরপেক্ষ নির্বাচন।” গণতন্ত্র মঞ্চের এ শীর্ষ নেতা আরো বলেন, “আমরা আগামী আরও এক/দুই মাস হয়তো দেখবো। আমরা চাই এরমধ্যে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সরকার একটা রোডম্যাপ তৈরি করবে। ইনডিফিনিট পিরিয়ডে রোডম্যাপ ছাড়া যদি চলতে যাই, তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে সরকারের ঘোষিত অ্যাজেন্ডার বাইরে অঘোষিত কোন অ্যাজেন্ডা আছে কি-না।” বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের পর যে নির্বাচন হবে সেখানে তারা অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে তার দল নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে, নাকি এককভাবে করবে এমন প্রশ্নে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সে বিষয়ে কোন দলের সঙ্গে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। সেটা হবে পরবর্তীকালে, পরিস্থিতির আলোকে। তবে ৫ ই আগস্ট দলীয় প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকস্মিক পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগের এর তৃণ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা নেতাকর্মীরা। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দেশত্যাগ ও আত্মগোপনে থাকায় দলীয় কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় রয়েছে। ফলে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন আওয়ামী লীগের অজানা ভবিষ্যৎ! গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মরণকালের ভয়াবহ নৈরাজ্য, সহিংসতা ও বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে এক বিপর্যস্তপূর্ণ বাংলাদেশ দেখলো দেশের মানুষ। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। প্রায় ষোলো বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের সাথে সাথে দলটিও হয়ে পড়েছে নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন। মন্ত্রী-এমপিসহ দলের নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। নতুন করে নেতাকর্মীদের নামে হচ্ছে মামলা। টানা প্রায় ষোলো বছর ক্ষমতায় থেকে গণরোষের মুখে অস্তিত্ব মুখথুবড়ে পড়া নৌকার হাল ধরবে কে? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক এই দলের রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। একাত্তরে এই দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতালাভ করেছে। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এই দলে যে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয় তা দূর করতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। বেগম জহুরা তাজউদ্দিন, মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান, আব্দুল মালেক উকিল প্রমুখ প্রবীণ রাজনীতিকের হাত ধরে অবশেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসে থিতু হয় এই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব। ২০২৪-এর ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ এখন সম্পূর্ণরূপেই নেতৃত্বশূন্য। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার পরিচালনার দুই সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই সকলের মুখে একটিই প্রশ্ন- কে ধরবে বৈঠা? বঙ্গবন্ধুর নাতি সজিব ওয়াজেদ জয় বিদেশে থাকেন। কোনো নেতা বিদেশে থেকে দলকে দলকে শক্তিশালী করা সম্ভব না! তাহলে দেশের ভিতর নেতৃত্ব শুন্য এ দলের  দায়িত্ব নেবে কে? প্রশ্ন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন সচেতন মানুষ। যদিও বর্তমানে দলীয় কর্মসূচি গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীক হতে দেখা গেছে। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত হাসিনা-পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশি সংবাদমাধ্যমে যেসব কথা বলেছেন সেখানে তার বক্তব্যের পরস্পরবিরোধিতা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার অব্যবহিত পরেই জয় তার প্রথম বার্তায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমার চিন্তার বিষয় না, আমার পরিবারেরও বিষয় না- আপনারা বুঝবেন।’ পরদিন ৬ই আগস্ট তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা রাজনীতিতে ফিরবেন না। আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।’ এরপর ৭ই আগস্ট আগের বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা একা না। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথাও যায়নি। নেতাকর্মী ও আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করতে প্রস্তুত।’ এমনকি জয় এও বলেছেন দল চাইলে তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন এবং দলকে আবার ক্ষমতায় আনবেন। জয়ের এসব কথায় দলের সংশ্লিষ্ট নেতারা কোনোভাবেই আস্থা আনতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ ও তাঁর মা শেখ হাসিনা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছিটকে পড়াতে জয়ের হঠাৎ  নেতৃত্বগ্রহণের ইচ্ছেকে সহজে গ্রহণ করছেন না কেউ। এদিকে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুসহ প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদেরও রয়েছেন নিষ্ক্রিয়। দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এবং দেশের ভিতরে আত্মোগোপন করে থাকা এই সময়ে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকেই আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি? দলের এই নেতৃত্বশূন্যতা ’৭৫-এর পরেও এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। ’৭৫-পরবর্তী ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময় দলের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন। রাজনীতিতে অনেকটাই অনভিজ্ঞ বেগম জোহরা তাজউদ্দিন ১৯৭৭ সালে এক সংকটময় মুহূর্তে দলকে পুনর্গঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন করে ছিলেন। তবে এবারের প্রেক্ষাপট তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০২৪-এর সংকট অতীতের যেকোনো সংকটকেই ম্লান করে দিয়েছে। ২০০৭ সালে যখন এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার গঠিত হয়; তখন বহুল আলোচিত মাইনাস টু ফর্মুলার একজন হিসেবে শিকার হতে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে কারাবন্দী করে সেনাসমর্থিত সরকার। ঐ বছরের ১৬ই জুলাই দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান। রাজনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতা কষ্টিপাথরে প্রমাণিত। তিনি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সামরিক সরকারের নানা ভয়-ভীতি আর প্রলোভনে যখন অনেক শীর্ষ নেতা দিগভ্রান্ত, তখন দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আবার এক মহাসংকটের ঘন অমানিশায় নিপতিত হলো আওয়ামী লীগ। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে- এবারের সংকট অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। বর্তমানে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন; এটা মানতেই হবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড়ো হওয়া ও বিদেশি জীবনে অভ্যস্ত বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন, এতে আস্থায় নিতে পারছেন না দেশের মানুষ। কেননা, বিগত প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে জয়কে প্রত্যক্ষভাবে কখনো সম্পৃক্তই করেননি। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে থেকে যায় প্রশ্ন? এদিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেন ও দেশে-বিদেশে থাকা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদগণ। সবার দৃষ্টি কোন দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। ডক্টর ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টাগণ বেশ সুবিধায় রয়েছে ব্যাপারটি তা নয়। প্রতিটি মুহূর্তে তারা নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সমন্বয়ককে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়েছে আন্দোলনের শুরুতে থাকা ছাত্র সমাজ। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে আনতে পারেনি বর্তমান সরকার।  দেশের সর্বত্র লুটপাট, সংখ্যালঘু এবং গণমাধ্যম অফিস ও কর্মীদের উপর হামলা মামলা প্রশ্নবিদ্ধ করছে বৈষম্য বিরোধী আগামীর বাংলাদেশকে! সম্প্রতি আদালতে আইনজীবী ছুরিকাঘাত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা সাবেক বিচারপতি দুষ্কৃতিকারীদের হামলার শিকার, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা অবকাঠামো।
আগামীর বাংলাদেশ সম্পর্কে বার্তা দিয়ে রাজনীতিবিদের ধারণা করছে, যথা সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্যমতে সরকার গঠন করা না হলে দেশ অনিশ্চয়তার ধোঁয়াশার মধ্যে পড়বে।

Side banner