Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তক: কেমন হওয়া উচিত


দৈনিক পরিবার | মো. ইউনুস আলী  জানুয়ারি ২২, ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম পাঠ্যপুস্তক: কেমন হওয়া উচিত

"আলোয় আঁধার কাটে" কথাটি যতটুকু সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য অজ্ঞতার আঁধার কেটে শিশুকে প্রকৃত মানুষ রুপে গড়ে তোলে একমাত্র পাঠ্যবই যদি সেটা হয় সুখপাঠ্য। ভিন্ন মত, ভিন্ন রূপ, ভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পাঠ্যবই নির্মিত হলে তা শিশুমনকে  রসে তো ভরপুর করেই না ; বরং শিশুমনে একের পর এক প্রশ্নের জন্ম দিতে থাকে। শিশুরা সংশয় আর উৎকণ্ঠায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে অজানা এক জগতে। সমাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি পাঠ্যবিধির আগেই শিশুমনে স্তরে স্তরে গেঁথে তোলে সমাজ, দেশ, জাতির প্রতি ভালোবাসা, ধর্মের প্রতি নিগূঢ় টান আর গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। জন্মের পর হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে ওষ্ঠধ্বনি দ্বারা মায়ের কাছে তার শ্রুতিমধুর ধ্বনিগুলো (বাবা, দাদা, নানা, মা) বারে বারে উচ্চারণ করে জানান দেয় জন্মভূমির প্রতিটি ধূলিকণা তার শিক্ষার অনুপ্রেরণা। শিশু যখন একটু বড় হয় সমাজ, প্রকৃতির শিক্ষার বাইরে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় পাঠ্যবই। 
"পড়িলে বই আলোকিত হই না পড়িলে বই অন্ধকারে রই।" কিন্তু বই যদি সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে অন্য কিছু দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে সেটাকে আর আলোর চাদড়ে আবৃত করা বলে না সেটা অন্ধকারে বুনে দেয় কুশিক্ষা। শিক্ষা মানেই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার যাত্রা। শিক্ষা মানেই সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রকে আলোর ছটায় আলোকিত করা। কিন্তু পাঠ্যবই যদি প্রকৃত শিক্ষাকে আড়াল করে কুশিক্ষা বহন করে তবে তা জাতিকে এমন এক অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সেই পাঠ্যবই আর শিশুমনকে বিকশিত করে না। শিক্ষা যদি হয় কুশিক্ষার আবরণে আদ্রিত তবে ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী প্লাবন নিয়ে আসে সমাজে। সমাজকে করে কলুষিত, পরিণত করে পাপের নরক রাজ্যে সবশেষে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, অরাজগতার এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে তাতে জুলাই বিপ্লবের পরেও তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে এসব অপকর্মের জবাবদিহিতা তো নাই, আবার অবস্থাদৃষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, তা রোধ করার সাধ্য বুঝি কারও নেই। পাঠ্যবইয়ে একের পর এক আপত্তিকর গল্প, অশ্লীল শব্দের ব্যবহার বিশিষ্টজনদের ভাবিয়ে তুলছে। শিক্ষার্থীরা হয়ে গেছে গিনিপিগ। তাদের যেমন ইচ্ছা তেমন পাঠ্যবই  তুলে দেয়াসহ দুর্বল, ভঙ্গুর শিক্ষানীতি দিয়ে শিক্ষাজীবন দূর্বিষহ করে তোলায় যেন একমাত্র উদ্দেশ্য।
পাঠ্যবই হওয়া উচিত সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান নিয়ে শিশুর অর্জিত ভাবনাকে আরো ভাবিয়ে তোলার মাধ্যমে জ্ঞান আরোহণের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করা, শিশুর মধ্যে নিহিত সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করা, জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে উৎসুক মনের বিভিন্ন প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দেয়া। তবেই না আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে। সারাবিশ্বে পাঠ্যপুস্তককে তথ্যসূত্রের বিশ্বস্ত মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে মৌলিক বিষয়গুলোর তথ্য সঞ্চালন। আর এই তথ্যগুলো সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন করা হয় যাতে শিশুরা তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে শিখতে পারে।
বিজ্ঞানবিষয়ক দার্শনিক পি ভি বেকন বলেছেন, "একটি পাঠ্যপুস্তক যদি কেবল শ্রেণিকক্ষের জন্য প্রস্তুত করা হয়, তবে সেটি যেন অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়।" মূলত গবেষকদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে প্রকাশিত প্রবন্ধ বা আর্টিকেল অনুসারে নির্মিত হতে হবে পাঠ্যপুস্তক। প্রত্যক্ষ উক্তিতে রচিত হবে পাঠ্যপুস্তক যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শক্তিশালী মনোভাব তৈরি হয়। বয়সভেদে বোধগম্যতার ভিত্তিতেই পাঠ্যপুস্তকে শব্দ চয়ন করা উচিত। একাডেমীশিয়ানদের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় যাতে তা বস্তুনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কোন সুযোগ নেই। প্লেজিয়ারিজম এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার পাঠ্যপুস্তকের মতো প্রতিটি পাতায় নিচের দিকে অথবা বইয়ের শেষে নির্ঘন্ট রাখা উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা তথ্যের উৎস পর্যন্ত পৌঁছে নিজের জ্ঞান ভান্ডার আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাবে। কিউআর কোড এবং হাইপারলিকেরও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে জ্ঞানের সুবিশাল রাজ্যে শিক্ষার্থীরা বিচরণ করে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে পারবে। বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোকে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলারও সুযোগ নেই। পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বলেছেন, বিজ্ঞানকে জানতে হলে ধর্মকে জানতে হয়। আবার ধর্মকে পর্যালোচনা করতে বা জানতে হলে বিজ্ঞানের প্রয়োজন হতে পারে। সেই জায়গা থেকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নির্মোহভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য শিক্ষার্থীদের জানাতে পারঙ্গম হতে হবে।
শিশুরা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে একটা বিনয়ের সমাজ উপহার দেবে এটাই প্রত্যাশা। ঘুষ, দুর্নীতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস মুক্ত একটা দেশ গড়ে তুলতে পাঠ্যবইয়ের বিকল্প নেই। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, "কল্পনাশক্তি জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান।" জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন রহস্যময় ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব। তাই পাঠ্যপুস্তকের কাজ হলো কল্পনাশক্তিকে শাণিত করা। আমাদের শিক্ষার্থীরাও ভবিষ্যতে এমন পাঠ্যপুস্তক পাবে—সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখকঃ
মোঃ ইউনুস আলী 
শিক্ষক, গহেলাপুর নবাব মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়।
রাণীনগর, নওগাঁ।

Side banner