Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

বিমান তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে স্কুলছাত্র শামীম


দৈনিক পরিবার | বিপুল মিয়া জানুয়ারি ১৩, ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম বিমান তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে স্কুলছাত্র শামীম

দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলে স্কুল ছাত্র শামীম রানা একটি বিমান (উড়োজাহাজ) তৈরি করে এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তার তৈরি করা বিমানটি উড়ানো ও এক নজর দেখতে প্রতিদিন ভিড় করেন আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষ। স্ব-চোখে তার তৈরী করা বিমানটি দেখে স্কুলছাত্র শামীম রানার বিস্মিত প্রতিভার প্রশংসা করেন।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিলুপ্ত ছিটমহলের হাবিবপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলামের বড় ছেলে শামীম রানা ও ফুলবাড়ী মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলছাত্র ছোট থেকে কাগজ দিয়ে বিমান তৈরি করে শিশু পাড় করেছেন।সে সময় মনের ভিতরে বিমান তৈরির স্বপ্ন দেখেন। গত এক দেড় বছর ধরে ইউটিউব ও গুগলে সার্চ করে দেখেন বিমান তৈরি কাজ। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশনে বিমান তৈরির একটা খবর দেখে তারও বিমান তৈরির ইচ্ছা জাগে। 
অভাব-অনটনের সংসারে শামীম রানা বিমান তৈরির টাকা কোথায় পাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও থেমে যাননি তিনি। প্রথমে কৃষক বাবার কাছে বিমান তৈরির কিছু টাকা আবদার করেন শামীম। কিন্তু বাবা-মা ছেলেকে বলতেন। এখন তোমার পড়াশুনা করার সময়। ভালো করে পড়াশুনা করো। কিন্তু শামীম রানা বাবা-মার কোন কথা না শুনে বিমান তৈরির জন্য টাকা আবদার করে আসছেন। পরে ছেলের আবদার পুরন করতে বাবা-মা টাকা দেন। সেই টাকা নিয়ে তার বিমান তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে-ঘেঁটে তিনি ককসিট দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস বিমান তৈরি করে। তার দীর্ঘ চেষ্টায় তৈরিকৃত বিমানটি সফলভাবে বেশ ৫ থেকে ১০ মিনিট ধরে আকাশে উড়িয়ে দেখেন। তার তৈরিকৃত বিমান বিলুপ্ত ছিটমহলের আকাশে উড়তে দেখে শামীম রানার পরিবারসহ পুরো বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের মাছে ব্যাপক প্রশংসায় ভাসছেন শামীম রানা। শামীম তার অদম্য মেধা দিয়ে বিমান তৈরির মতো বড় স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলার বিষয়টি এখন বিলুপ্ত ছিটমহল বাসিন্দাদের মুখে মুখে আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে। 
এক সময় বিলুপ্ত ছিটমহলের হাবিবপুর গ্রামসহ পুরো ছিটমহলবাসী র্দীঘ ৬৮টি বছর অন্ধকারের জীবন থেকে মুক্তির কথা চিন্তা করাই ছিল স্বপ্ন। বন্দিদশায় জীবন-কাটতো তাদের। ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা, চলাচলের কোনো রাস্তা-ঘাটই ছিল না। নদী, খাল, ডোবা এমনকি জমির আইলের ওপর দিয়ে মানুষজন কোনোমতে যাতায়াত করতেন। একরকম পরিচয় গোপন রেখে কিছু বাসিন্দা বাংলাদেশের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পড়াশুনা করেছেন। কিছু মানুষ পরিচয় গোপন করে ভয়ে ভয়ে করে রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন। এভাবেই চলতো তাদের ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন। সেই অবর্নণীয় দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটেছে সাবেক ছিটমহল বাসিন্দাদের। নাগরিকত্ব পাওয়ার পাশাপাশি ছিটবাসীরা পেয়েছেন আধুনিক জীবনযাপনের ছোঁয়া। সেই আধুনিক জীবন গড়ার লক্ষ্য থেকে স্কুলছাত্র শামীম রানার বিমান তৈরির  করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
স্কুলছাত্র ও উদ্ভাবক শামীম রানা জানান, তার বিমানটি বাংলাদেশ বিমানের আদলে তৈরি করেছেন। ককসিটে তৈরি মূল বিমানটির লম্বায় ৫৬ ইঞ্চি। আর দুপাশের ডানা ৫০ ইঞ্চি লম্বা। ওজন ১ কেজি ৩০০ গ্রাম। ওই বিমানে ৯৪০ গ্রাম ওজনের ২টি ব্রাশলেস ড্রোন মোটর ব্যবহার করা হয়েছে। রিচার্জেবল লিপো ব্যাটারির শক্তিতে চালিত বিমানটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে গতি-ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্তমানে ওই বিমানটি তিন কেজি ওজন বহন করতে পারে। 
তিনি জানান, বিমান তৈরিতে এ পর্যন্ত তার ১৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিমানটি আকাশে টানা সর্বোচ্চ ১০ মিনিট উড়তে পারে। আমি বিমানটির নাম দিয়েছি বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (অচিন পাখি) এই বিমানটি হাফ কিলোমিটার রেঞ্জে চলতে পারে। তবে রেঞ্জ আরও বাড়ানো সম্ভব। টাকা জোগাড় হলে বিমানটিতে ১ থেকে ২ জন মানুষ নিয়ে চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করবো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চীন ও আমেরিকার মতো উন্নত প্রযুক্তির মনুষ্যবিহীন প্লেন বানাতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস। তার স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিমান তৈরি করবেন। এ জন্য তিনি সবার দোয়া কামনা করেছেন। 
শামীম রানার বাবা শহিদুল ইসলাম জানান, বাহে আপনারাতো সবেই জানেন। দীর্ঘ ৬৮ বছর অন্ধকার জীবন পার করেছি। কি কষ্ট করেছি এটা সবার জানা। অন্ধকার জীবন থেকে ৯ টি বছর পেরিয়ে গেল। এই ৯ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবার উন্নত জীবন জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আমরা শিক্ষার স্বাদ না পেলেও আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। আমার ছেলেও ফুলবাড়ী মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তার স্বপ্ন সে বিমান তৈরি করবে টাকার জন্য আমাকে চাপ দিতো। প্রথমে আমি নিষেধ করেছি। তুমি কিভাবে বিমান তৈরি করবে। সেকোন কথা শুনবে না। তার শুধু টাকা চাই। পরে অনেক কষ্টে তাকে টাকা দিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে ৯ মাস পড়াশুনার পাশাপাশি বিমানটি তৈরি করেছে। এখন আমার ছেলের তৈরি করা বিমানটি আকাশে উড়ছে। বিমানটি দেখতে প্রতিদিনেই বাড়ীতে মানুষে ভীড় জমে। এখন সত্যি খুবই ভালো লাগছে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। 
ওই গ্রামের সিয়াম আমিনুল ইসলাম ও মতিয়ার রহমান বলেন, টানা ৬৮ বছর অন্ধকারে ছিলাম। এখন আমাদের প্রতিটি পরিবারের মাঝে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তার জলন্ত উদাহরণ শামীম রানা। সে নিজেই তৈরি করেছে বিমান। তার তৈরিকৃত বিমানটি যখন আকাশে উড়তে দেখে আমাদের মধ্যে অনেক আনন্দ লাগে। আমরা তার সাফল্য কামনা করছি।
ছিটমহলের আন্দোলনের সাবেক নেতা আলতাফ হোসেন ও নুর আলম সরকার বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমরা এখন গর্বের সহিত বসবাস করছি। দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার আমাদের জীবন থেকে  মুক্তি পাওয়ায় আমাদের ছেলে-মেয়েদের দিন দিন উন্নত জীবন গড়ছে। অসাধারণ প্রতিভা থাকায়  শামীম রানা একটা বিমান তৈরি করে আমাদের বিলুপ্ত ছিটমহলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি আরও বড় কিছু করে দেখাতে পারবে।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জানান, এক স্কুলছাত্র একটি বিমান তৈরি করেছে বিষয়টি জানি। নিঃসন্দেহে একটা ভালো কাজ করেছে। এটা ফুলবাড়ীর গর্ব। তার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে তাকে সহায়তা করার আশ্বাস দেন ইউএনও।

Side banner