Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
চুনতির হযরত শাহ কেবলা ও স্মৃতি বিজড়িত

লোহাগাড়ার ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ)


দৈনিক পরিবার | ফাহাদ, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি অক্টোবর ২, ২০২৪, ১২:০৮ পিএম লোহাগাড়ার ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ)

চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলাধীন চুনতি একটি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের সুনাম ও খ্যাতি প্রাচীনকাল থেকে সুদূরপ্রসারী। এখানে রয়েছেন বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও অলি-দরবেশের মাজার। গ্রামের মাঝে রয়েছে প্রায় ১ কিঃমিঃ আয়তনবিশিষ্ট কবরস্থান এবং ওইখানে রয়েছে প্রায় শতাধিক অলি-দরবেশের কবর। এ’গ্রামের আদি পরিবারগুলোর অন্যতম হল সিকদার পরিবার। আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রঃ)-এর বংশধর হযরত মওলানা কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ আলী (রহঃ) পরিবারের তথা হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রহঃ)-এর পরিবার। মাওলানা কাজী ইউসুফ আলী (রহঃ)-এর পুত্র হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ (রহঃ)। হযরত শাহ সাহেব কেবলা’র পিতার নাম হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ (রহঃ)।
হযরত শাহ সাহেব কেবলা ১৯০৭ সালে অত্র উপজেলার ইউসুফ মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তিনি পরিবারের মধ্যে অনন্য প্রতিভায় লালিত-পালিত হতে থাকেন। বাল্যকালে তিনি নিজ গৃহে আমিরাবাদ নিবাসী হযরত মাওলানা বজলুর রহমান (প্রকাশ নোয়া মৌলভী সাহেব)-এর তত্বাবধানে কুরআন শিক্ষাসহ আরবী, ফারসী, বাংলা ইত্যাদির সবক গ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে পবিত্র কোরআন মজিদ শেষ করে উর্দু, ফারসী, বাংলা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। এরপর সাতকানিয়া আফজল নগরের হযরত মাওলানা আবদুল বারী (রহঃ)-এর মাদারসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। এক জায়গায় তিনি বেশী দিন থাকতেন না। অল্প কিছুদিন পর তিনি বাঁশখালীর ছনুয়া মাদরাসায় হযরত ফজলুল হক (রহঃ)’র তত্ত্বাবধানে শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষকগণ তাঁর প্রতি আলাদা নজর রাখতেন। তিনি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে ভালোবাসতেন। কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা পছন্দ করতেন না। ছনুয়া মাদরাসা থেকে কিছুদিন পর চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরা দারুল উলুম আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেসগণের সান্নিধ্যে থেকে কৃতিত্বের সাথে জামাতে ছিওম পাশ করেন। মাদরাসার ওস্তাদগণ তাঁকে উচ্চ বংশের সন্তান ও মাদারজাত অলী বলে জানতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহর দেয়া জ্ঞানই আসল জ্ঞান। অর্থাৎ, আল্লাহর দেয়া লেখাপড়াই আসল লেখাপড়া। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে তিনি কলকাতা গিয়ে কলকাতা আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি ফাজিল ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যয়নরত অবস্থায় হযরত মাওলানা বশির আহমদ (রহঃ) এর কন্যা মুছাম্মৎ মাহমুদা খাতুনের সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর গর্ভে শাহজাদা জামাল আহমদ (রহঃ) , শাহজাদা জাকের আহমদ ও শাহজাদী আমেনা বেগম জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত শাহ সাহেব কেবলা ছিলেন এক জ্যেতির্ময় চেহারার অধিকারী।
হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রহঃ) ছয়বার হজ্জ্ব পালন করেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তাওহীদের আলো জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য তিনি অস্থীর হয়ে পড়েন। ফলে, তিনি মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সঃ) এর আয়োজন করেন। প্রথম ১৯৭৩ সালে দু’দিন, দ্বিতীয়বার ১৯৭৪ সালে তিন দিন, তৃতীয়বার ১৯৭৫ সালে ৫ দিন, চতুর্থবার ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, পঞ্চমবার  ১৯৭৭ সালে ১২ দিন, ষষ্ঠবার ১৯৭৮ সালে  ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিন এবং ১৯৮০ সালে ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ) আয়োজন করেন। তবে, নিতান্ত দুঃখের বিষয় যে, এই সালের ৪ আগষ্ট চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের হেমসেন লেইনস্থ ইউসুফ মিঞার বাড়ি থেকে চুনতি আসার পথে পটিয়ার পর খরনা ব্রীজ অতিক্রম করলে মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। উক্ত দূর্ঘটনায় হযরত শাহ সাহেব কেবলার দু’চোখে আঘাত লাগে। বিভিন্ন চিকিৎসার পর একটি চোখ ভাল হলেও অন্য একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। এরপরও হযরত শাহ সাহেব কেবলা স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পিছ পা হননি। সুষ্ঠভাবে মাহফিল সম্পন্ন করতে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল অনন্য প্রতিভাময়। মাহফিলে আগত দর্শনার্থীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা ছিল। তবে, হযরত শাহ সাহেব কেবলা শিশুদেরকে খাওয়াতে বেশী পছন্দ করতেন। যে কারণে প্রতিদিন মাহফিল চলাকালীন সময়ে হাজার হাজার শিশুর সমাগম ঘটত। শিশুরা অতি আনন্দের সহিত খাবার গ্রহণ করত এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্তরাও তৃপ্তিসহকারে খাবার খেতেন। হযরত শাহ সাহেব কেবলার এহেন মহতী উদ্যোগ দেখে ভক্তরা নানাভাবে সহযোগিতা করতে থাকেন। দেশবরণ্য ওলমায়ে কেরাম মাহফিলে উপস্থিত হয়ে মূল্যবান তাশরীক পেশ করতেন। এরপর থেকে ১৯ দিনব্যাপী সীরত মাহফিল (সঃ)-এর জন্য ১৩ একর আয়তনবিশিষ্ঠ সীরত মঞ্জিলের পাশে সীরত ময়দান সৃষ্ঠি হয়। সীরত ময়দানের পশ্চিম পার্শ্বে নির্মিত হয় বৃহদাকারের মসজিদে বায়তুল্লাহ। ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর দিবাগত রাত সোয়া ১২ টায় হযরত শাহ সাহেব কেবলা অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইহজগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহ সান্নিধ্য লাভের জন্য পর জগতে চলে যান (ইন্না... রাজেঊন)। মসজিদের বায়তুল্লাহর দক্ষিণ পার্শ্বে তাঁকে দাফন করা হয়। বর্তমানে শোভা পাচ্ছে হযরত শাহ সাহেব কেবলার মাজার শরীফ। তাই প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১৫ সেপ্টেম্বর ৫৪ তম সীরত মাহফিল (সঃ) শুরু হয়েছে। আগামী ০৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত মাহফিলের আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

Side banner