একটি দেশের পরিবেশ ভালো না খারাপ, তা নির্ভর করে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে আছে বায়ুমান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য, বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ, কৃষি ইত্যাদি।
এসব বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) বা পরিবেশ সুরক্ষা সূচক যৌথভাবে প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সূচক অনুযায়ী ২০২৪ সালে পরিবেশগত দিক থেকে এগিয়ে ছিল ইউরোপের দেশগুলো। পিছিয়ে ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। তালিকার শীর্ষে থাকা ১০ দেশ কোনগুলো, জেনে নেওয়া যাক।
১। এস্তোনিয়া
পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে সবার ওপরে ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়া। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎসে রূপান্তরের মাধ্যমে গত দশকে দেশটি গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ৪০ শতাংশ কমিয়েছে। এ ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশটি সৌর, জল ও বায়ুবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত উত্তোরণ ঘটাচ্ছে। শিল্প খাতে অনেক কম দূষণ ও পরিবেশগত কঠোর নীতিমালার কারণে দেশটির বাতাস সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন। পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে দেশটির স্কোর ৭৫ দশমিক ৭।
২। লক্সেমবার্গ
তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে লুক্সেমবার্গ। পরিবেশগত স্থায়িত্বের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে লুক্সেমবার্গ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। সূচকে দেশটির স্কোর ৭৫ দশমিক ১। আয়তনে ছোট হলেও দেশটির পরিবেশগত উচ্চাভিলাষী নীতি রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি দেশটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানিনির্ভর যানবাহনকে উৎসাহিত করছে।
৩। জার্মানী
পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে ৭৪ দশমিক ৫ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে জার্মানি। দেশটি কঠোর পরিবেশগত নীতি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবহনজনিত দূষণ এবং শিল্প খাতের কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে কঠোর নীতি অনুসরণ করে তারা। ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে দেশটির। জার্মানির সরকার কার্যকর উপায়ে জীববৈচিত্র্য ও বনাঞ্চল রক্ষায় কাজ করছে এবং টেকসই কৃষিকে উৎসাহিত করছে।
৪। ফিনল্যান্ড
পরিবেশগত স্থায়িত্বের দিক থেকে বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়া দেশগুলোর একটি ফিনল্যান্ড। পরিবেশবান্ধব দেশটি সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বাতাস ও পানির জন্য প্রসিদ্ধ। ফিনল্যান্ডের ৭৫ শতাংশ বনভূমি। দেশটির সরকার বনায়ন ও বন্য প্রাণী সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সূচকে ৭৩ দশমিক ৮ স্কোর নিয়ে চতুর্থ স্থানে ফিনল্যান্ড। দেশটিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সবুজ প্রযুক্তি নিয়ে শক্তিশালী নীতি রয়েছে।
৫। যুক্তরাজ্য
কার্বন নিঃসরণ কমাতে ও বায়ুর গুণমান উন্নত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে ৭২ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে দেশটি। যুক্তরাজ্য ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশ এটি। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে দেশটি সৌরশক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎসের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানো, যানবাহনের দূষণ ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ওপর কঠোর নিয়মকানুন প্রয়োগ করছে দেশটি।
৬। সুইডেন
সুইডেন বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশসচেতন দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই পরিবেশ রক্ষা সূচকে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে থাকে এ দেশ। সুইডেন ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে। দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তির ৬০ শতাংশের বেশি আসে জলবিদ্যুৎ, বায়ু ও জৈবশক্তির মতো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। দেশটির কঠোর পরিবেশগত নীতিমালা রয়েছে। প্রায় ৯৯ শতাংশ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং এমনকি জ্বালানি উৎপাদনে অন্য দেশ থেকে বর্জ্য আমদানি করে সুইডেন। দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ ভূখণ্ড বনভূমি আচ্ছাদিত। দেশটি টেকসই বনায়ন অনুশীলন করে।
৭। নরওয়ে
নরওয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করেছে। দেশটির প্রায় ৯৮ শতাংশ বিদ্যুৎ জলবিদ্যুৎ থেকে আসে, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি করে তুলেছে। শক্তিশালী প্রণোদনা ব্যবস্থা ও অবকাঠামোর কারণে নরওয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। দেশটিতে বিক্রি হওয়া ৮০ শতাংশ নতুন গাড়ি বৈদ্যুতিক। নরওয়ে শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাতাসের মান বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশটির অসলো ও বার্গেনের মতো শহরগুলো পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, গণপরিবহন ও টেকসই নগর–পরিকল্পনার ওপর জোর দিচ্ছে।
৮। অস্ট্রিয়া
পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে ৬৮ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে অষ্টম অবস্থানে আছে অস্ট্রিয়া। দেশটি পরিবেশ সংরক্ষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ক্রমেই বেশি এগোচ্ছে। অস্ট্রিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে জল, বায়ু ও সৌরশক্তি থেকে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দেশটির নির্ভরতা কমাচ্ছে।
৯। সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ড জলবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক জ্বালানিশক্তির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ফলে দেশটিতে কার্বন নিঃসরণ সবচেয়ে কম। কঠোর পরিবেশগত নিয়মকানুনের কারণে দেশটির বাতাস ও পানি অনেক বিশুদ্ধ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহারেও দেশটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। সুইজারল্যান্ডের ৩০ শতাংশের বনভূমি। দেশটি তার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করে।
১০। ডেনমার্ক
ডেনমার্কের উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশই আসে বায়ুবিদ্যুৎ থেকে। ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে দেশটি। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি কার্বন নিঃসরণ ৭০ শতাংশ কমানো ও ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :