Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তাড়াহুড়ো চায় না দলগুলো


দৈনিক পরিবার | নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ১০:৩৯ পিএম জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তাড়াহুড়ো চায় না দলগুলো

অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, বামমঞ্চ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব রাজনৈতিক শক্তি অংশগ্রহণ করেছে।
বৈঠকে তারা জানিয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো চান না রাজনৈতিক নেতারা। ঐকমত্য থাকলেও সময় নিয়ে সবার মতামতের ভিত্তিতে তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা। তবে পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন ছিল কি না, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এমন প্রশ্ন রাখে বিএনপির প্রতিনিধি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে শুরু করেন। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বৈঠক শুরু হয়।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে বৈঠক শেষ হয়। বৈঠক শেষে ৫টা ৫৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে বেরিয়ে যান। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন। নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নানা মতের কথা তুলে ধরেছেন তারা। অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টাও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
অন্তর্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, আরও অনেক বেশি আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন তা নেওয়া যেতে পারে। এ বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা হয়েছে। সবাই বলেছেন এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্র দরকার আছে। অনেক পরামর্শ এসেছে। মোটাদাগে বলতে গেলে এ ঘোষণাপত্রে সবার অবদান ঠিকমতো করে উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। এই ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক বা আইনগত প্রকৃতি কী হবে, তা স্পষ্ট করতে হবে। এটা করার জন্য যতটুকু সময় লাগা প্রয়োজন নেওয়া যেতে পারে। তবে চেষ্টা করা উচিত, যাতে অযথা কালবিলম্ব না হয়। অযথা সময়ক্ষেপণ না হয়।
বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে অংশ নেন। তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আইনি কী গুরুত্ব রয়েছে, তা নির্ধারণ করতে অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা প্রশ্ন করেছি যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন ছিল কি না। যদি থেকেই থাকে তাহলে তার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আইনি গুরুত্ব নির্ধারণ করতে বলেছি। যেন এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল না ধরে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, একটা ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন সেটা অনুভব করেছে প্রত্যেকটি দল। তবে তাড়াহুড়ো করলে ঘোষণাপত্র তৈরিতে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। সময় নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, অভ্যুত্থানের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসসহ সবকিছু মিলিয়ে একটা সুলিখিত ঘোষণাপত্র কীভাবে তৈরি করা যায়, সেই আলোচনা হয়েছে। আমরা আলাদা আলাদাভাবে প্রস্তাবনা দেব। পরবর্তী সময়ে সবগুলোকে একত্র করে একটি সুন্দর ঘোষণাপত্রে রূপান্তরিত করা হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, আমরা বলেছি, এটা যেন তাড়াহুড়া করে যেনতেন প্রক্রিয়ায় না করা হয়। ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য সরকারের দিক থেকে এই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার। এটা কী হবে? আইনের দিক কী? রাজনৈতিক দিকগুলো কী? এ প্রশ্নগুলোর জবাব সবার ঐকমত্যের জায়গা আসবে।
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বতী সরকারের প্রধানের আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনদের ডাকা হয়েছিল। সেই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরি। গণঅভ্যুত্থানের যে প্রেক্ষাপট, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে, গণঅভ্যুত্থান ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের যেই দিকনির্দেশনা দেয়, এই বিষয়গুলো একটা দলিলে একত্রিত হতে পারে। তবে সেটার একটা পদ্ধতিগত দিক কী হবে? দলিলটা কীভাবে তৈরি হবে? এই বিষয়ে আমরা আমাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছি। আশা করি সেই অনুযায়ী অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কর্মপন্থা তৈরি করবেন।
ঐতিহাসিক দলিল তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, শব্দে শব্দে সব দলের একমত হওয়া কঠিন বা দরকারও নেই। আমাদের প্রক্রিয়ায় একমত হওয়া দরকার। কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গণঅভ্যুত্থানের ফরমান লিখিত হবে। সব দল তা সম্মতির ভিত্তিতে গ্রহণ করবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো।
ঘোষণাপত্র তৈরিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা অন্য কোনো কমিটি বা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ফুয়াদ।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে হতাশ হয়েছি। ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়নি। এর পেছনে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হয়েছে। সেসব আন্দোলন ঘোষণাপত্রে সংযুক্ত করতে বলেছি। যে ঘোষণাপত্র দেখানো হয়েছে তা কারা লিখেছে, সে জিজ্ঞাসার কোনো সদুত্তর পাইনি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে তা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি। ঘোষণাপত্রের জন্য আরেকটি জাতীয় কমিটি বা কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছি।
সরকারের মধ্যে বিপ্লবের কিছুই দেখেন না জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি জুনাইদ আল হাবিব বলেন, ‘সরকার আরও বিপ্লবী হবে। পরাজিত শক্তির দোসর এবং তাদের সহযোগী যে যেখানেই আছে প্রত্যেককে ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ঘোষণাপত্রের জন্য আমরা একটা কথা বলে এসেছি। অনেকগুলো বিষয় যেহেতু এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই জায়গায় ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যাকেও সংযোগ করতে হবে। সে কথাটা আমরা বলে এসেছি।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব কাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ছাত্রদের কেন জুলাই বিপ্লব ও ৫ আগস্টের ঘোষণাপত্রের জন্য আল্টিমেটাম দিতে হয়? সে প্রশ্ন প্রধান উপদেষ্টাকে করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কেন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বর্তমান সরকারের? তার কারণ খুঁজে বের করে দূরত্ব কমিয়ে আনতে বলেছি। ঘোষণাপত্র লিখতে হলে মৌলিক জায়গায় এক হতে হবে। সেটা জানিয়েছি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি আমরা সেই ৩১ ডিসেম্বর রাত থেকে ধৈর্য ধারণ করে যাচ্ছি এবং এখনো ধৈর্য ধারণ করছি। আমরা দেশের জনগণকে বলব আপনারা আরও কিছু সময় ধৈর্য ধারণ করুন। বাংলাদেশে যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে উত্তরণের পথে যেতে হয়। এই ঐতিহাসিক দলিল ছাড়া এটি সম্ভব না। এই ঐতিহাসিক দলিলের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার জন্য আমরা সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি। তারা সম্মত হয়েছে, আশা করি আমাদের যাত্রা একসঙ্গে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য হবে।
কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময়সীমা নিয়ে অনেকে বলেছেন। সুনির্দিষ্ট কোনো ডেডলাইন হয়নি। তবে সবাই সম্মত হয়েছে যে অনেক বেশি দেরি না আবার খুব তাড়াতাড়ি না। দ্রুত সময়ের মধ্যে সবার পর্যবেক্ষণ নিয়ে এটি প্রকাশ করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র জারি করতে পারব বলে আশা করেছিলাম। সরকারকে সেভাবে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে দেখি নাই। তারপরও তারা যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে তার জন্য সাধুবাদ বানিয়েছি। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন মিলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন ও সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা হবে, এটা এখন নিশ্চিত। পরবর্তী ধাপে আলোচনা করব জুলাই ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে। যার মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। আমরা আশাবাদী, অবিলম্বে ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারব। আন্তর্জাতিকভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্বীকৃত দিতে পারব।
খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের বলেছেন, ডকুমেন্টসে কিছু ভুল-ত্রুটি আছে। সেগুলো ঠিক করতে বলেছি। সংবিধান সংশোধন করতে বলেছি।
এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি সব ছাত্রদের অংশগ্রহণ। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সব ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছি।’
এদিকে বৈঠক শুরুর আগে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠকে যোগ দেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র শামান্তা শারমিন, আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া যোগ দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও জাতীয় গণফ্রন্টের কামরুজ্জামান।

Side banner