জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পাঁচ সাংবাদিক পরিবারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) বিকেল ৩টায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স রুমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চেক দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাদের গনি চৌধুরী।
আরো উপস্থিত ছিলেন কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবু তাহের, নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম, কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হায়দার আলী, নিউজ২৪-এর নির্বাহী সম্পাদক ফরহাদুল ইসলাম ফরিদ, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন হোসেন পাভেল, বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেল ও নির্বাহী সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টুসহ অনেকে।
এ সময় কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘আমি সব শহীদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। জুলাই বিপ্লবের সময় দেশ ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছুই ছিল না। সাদা কে সাদা কালোকে কালো বলার কোন উপায় ছিল না। দেশের সব কিছুই চলত এক ব্যক্তির ইচ্ছায়। গণমাধ্যমে ততটাই লেখা যেত যতটা সরকারের পক্ষ থেকে চাইত। জুলাই বিপ্লবের সময় কোনো দাবি অথবা কথা বললেই গুলি চালানো হতো। সে সময় অসংখ্য ছাত্রকে আমরা দেখেছি ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তায় পড়ে থাকতে। এমন বীভৎস চিত্র একটি স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব দেশে কখনো কল্পনাই করা যায় না। নিজ দেশের কোনো সরকার প্রধান এমনটা করতে পারে, এটা কোনো সভ্য দেশে চিন্তাই করা যায় না।’
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘অনেকেই বলেছেন আজকে শহীদ পরিবারের জন্য দুখের দিন, তবে আমি বলব এর থেকে গৌরবের আর কিছু হতে পারে না। কারণ কয়জনের ভাগ্য থাকে বীরের ভাই হওয়া, বাবা হওয়া, মা হওয়ার এবং সন্তান হওয়ার। আপনাদের সন্তানরা একটি জাতিকে রক্ষা করেছে।’
কাদের গনি বলেন, ‘আমাদের বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহীদ পরিবারের সকলকে সালাম ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দেশের জন্য যারা কাজ করেন তিনি সব সময় তাদের পাশে নীরবে দাঁড়ান। বসুন্ধরা গ্রুপ সব সময় আপনাদের পাশে থাকবে।’
জুলাই বিপ্লবের শহীদরা আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছেন উল্লেখ করে কাদের গনি বলেন, ‘সংবাদপত্রে কোনো আপস হবে না। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন থেকে ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করব। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা পেটডগের ভূমিকা পালন করবে না অতীতের মতো।’
কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, ‘আজকের এই আয়োজন কোনো আনন্দের নয়। এটি কষ্টের একটি সময় শহীদদের পরিবারের জন্য, এবং আমাদের জন্যও। বসুন্ধরা গ্রুপ এর আগেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ছেলের ভরণ-পোষণের জন্য সহায়তা দিয়েছেন। পাশাপাশি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের সহধর্মিণী নিজে জুলাই ফাউন্ডেশনে ৫ কোটি টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। সেখান থেকেও এই শহীদ পরিবার সহায়তা পাবে। তবে অনুদানের থেকে বড় বিষয় হচ্ছে, এসব পরিবারের জীবিকার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া। ইতিমধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের ভাইকে বসুন্ধরা গ্রুপে চাকরির ব্যবস্থা করেছে।’
কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হায়দার আলী বলেন, ‘শহীদ পরিবারের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়াম্যান ১ কোটি টাকার চেক অনুদান দিয়েছেন। বসুন্ধরা গ্রুপ সকল প্রকার মানবিক কাজে এগিয়ে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের এ আয়োজন। এ জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মহোদয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেল বলেন, ‘যারা সন্তান হারিয়েছে তাদের কষ্ট সব থেকে বেশি। এই শহীদ পরিবারের মধ্যে প্রিয় আমার অধীনেই চাকরি করেছিল। তিনি খুবই সাহসী তরুণ ছিলেন এবং দায়িত্বের প্রতি অটল ছিলেন। তার শহীদ হওয়ার ঘটনা আমি যখন শুনেছিলাম তখন চিন্তা করছিলাম এই খবর যেন মিথ্যা হয়। আমরা ধন্যবাদ জানাই বসুন্ধরা গ্রুপকে ও কালের কণ্ঠের এই মহৎ উদ্যোগকে।’
ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন হোসেন পাভেল বলেন, ‘শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সব শহীদ ও আহতদের পাশে দাঁড়াব। শহীদ পরিবারের সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’
এ সময় শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা সামসিয়ানা জাহান বলেন, ‘প্রথম যখনা আমি বসুন্ধরা গ্রুপের অনুষ্ঠানে এসেছিলাম তখন আমার ছেলের ছবি দেখে একদিকে যেমন গর্ভে বুক ভরে যায়, অন্যদিকে কষ্টেও বুক ফেটে যায়। যে সে এখন আমার সঙ্গে নেই। আমাদের সন্তানেরা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। যে অর্থ আপনারা না চাইতেই দিয়েছেন সে জন্যও আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার ছেলের ছোট একটা মেয়ে আছে। এই অর্থ যেন আমি আমার নাতনির জন্য সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে পারি।’
হাসান মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি বলেন, ‘আমার স্বামী যখন মারা যান এর কিছুক্ষণ আগেও কথা হয়েছে। তখন এত আওয়াজ শুনে আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি ঝামেলা থেকে সরে যাও। তখন সে আমাকে বলেছিল, এটা আমার দায়িত্ব আমি যেতে পারব না।’
দৈনিক ভোরের আওয়াজের গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি শাকিল হোসেনের বাবা বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপ যেভাবে শহীদ পরিবারের দুঃখ-বেদনার পাশে দাঁড়িয়েছে তার কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার নেই। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান একজন দানবীর হিসেবে পরিচিত। তিনি যেন সকল শহীদ পরিবারের পাশে থাকতে পারেন সে কামনা করছি।’
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৯ জানুয়ারি কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শহীদ পাঁচ সাংবাদিক পরিবারকে সম্মাননা স্মারক এবং প্রত্যেককে দুই লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শহীদ পাঁচ পরিবারকে এক কোটি টাকা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় তিনি প্রত্যেকের নামে ওই টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে মাসে মাসে তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফা শহীদ পরিবারের ভরণ-পোষণে ব্যবহার করার অনুরোধ করেন।
শহীদ পাঁচ সাংবাদিক হলেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদী, তিনি ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গুলিতে শহীদ হন। দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের সাবেক ভিডিও জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়, তিনি ১৯ জুলাই ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডে সংঘর্ষ চলাকালে শহীদ হন। দৈনিক ভোরের আওয়াজের গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি শাকিল হোসেন, উত্তরার আজমপুরে ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলতে গিয়ে শহীদ হন। দৈনিক নয়া দিগন্তর সিলেট ব্যুরোপ্রধান আবু তাহের তুরাব ও দৈনিক খবরপত্রের প্রদীপ ভৌমিক (৫৫), তিনি ১৯ জুলাই সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
আপনার মতামত লিখুন :