মাত্র ১৪ বছর বয়সী নন্দিনী কে ছেড়ে স্বামী জসিম চলে গেছে আজ ৪ মাস। কন্যা শিশু (১ বছর) পরী কে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল নন্দিনীর। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দু'জনই গ্রাম করতো। এখন ছোট্ট বাবুকে একা রেখে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এখন অনেকটা পরগাছার মতো জীবন তার। নন্দিনীদের আসল বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর। পদ্মার করালগ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে নৌকায় ভাসতে ভাসতে শেষমেশ ঠাঁই হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর সদরের কান্দাপাড়ার বালুর মাঠের বেদে পল্লীতে। সে জানায়, জলেভাসা পদ্মের মতো আমার জীবন। কষ্টে ভরা আমাদের জীবন।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফায়ারসার্ভিস সংলগ্ন কান্দাপাড়ার বেদে পল্লীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে অস্থায়ীভাবে ৫০টি বেদে পরিবারে ৩ শতাধিক মানুষের বসবাস।
কাঠফাটা রোদ আর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ও তীব্র ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস তাদের। বেদে পরিবারে জন্ম নেয়াই যেন তাদের আজন্ম পাপ। কথা হয় বেদে পল্লীর অনেকের সাথে।
তারা জানান, দুঃখ ও কষ্ট গাঁথা জীবনের কাহিনি। সাদামাটা জীবনযাপন তাদের। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিটি দিন তারা কাটায়। একটু সুখের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কঠোর পরিশ্রম করে। এরা রহস্যময় মানুষ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে।
স্থানভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্র্যসব পেশা। বেদেদের বাহন নৌকা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে নেয়।
তাদের জীবন যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বেদে কন্যা সিমা, আছমা ও কেয়া জানালেন, স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখার রহস্য। পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে। তাদের বিশ্বাস এতে স্বামীরা তাদের ছেড়ে অন্য কারো কাছে যাবে না। তারপরও অনেকে চলে যায়।
তারা আরও জানালেন, তারা দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারে বেদে সম্প্রদায়। তাবিজ-কবজ বিক্রি, জাদুটোনা আর সাপ খেলা দেখিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় ছিন্নমূল, অসহায় বেদে সম্প্রদায়কে।
তারা রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে বা পরিত্যক্ত জমি, খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠের পাশে অথবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়ে। আবার একদিন উধাও হয়ে যায়, কেউ খবর রাখে না তাদের।
সময়ের আবর্তে উন্নতির পরিবর্তে বেদে সমাজের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই তারা অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদী। নদী ছেড়ে কোথায় যাবে এসব বেদে। তাদের নেই কোনো শিক্ষা, নেই কোনো কাজের বিশেষ যোগ্যতা।
এভাবেই বেদের জীবনের শেষ হয়ে যায়। বেদেরাই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ। বাংলাদেশ সরকার কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ যদি আমাদের একটু দেখতেন তাহলে আমরা খুবই ভালো করে জীবন অতিবাহিত করতে পারতাম, এমনটাই বললেন বেদে সরদার নুর মিয়া।
বেদেদের জীবন অধিকারবিহীন। তাদের মৌসুমী শীত, ঝড়, তুফান, গরম বুকে ধারণ করা যে কত কষ্টকর তারাই বুঝে একমাত্র। বেদেদের বাড়ি-ঘর, মাথার ওপর ছাদ, সামাজিক মর্যাদা জন্ম থেকে আজও তারা বঞ্চিত! কেন?
তারা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো পাশাপাশি টেঁটা দিয়ে মাছ শিকার, সিঙ্গা, তাবিজ, ছাতা, পুরোনো তালা মেরামত, কবজ, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো এই ছিল বেদে সম্প্রদায়ের গন্তব্যহীন রাজ্যের আস্তানায় বিভোর। রাস্তার ধারে, কখনও মেঠোপথের ধারে ও ফাঁকা মাঠে ছঁই বা ঝুপড়ি, মাচা, তুলে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে দিন-রাত কাটান।
লোকমুখে আছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’। এদেশে বেদেদের জাত প্রথার শিকার। বিশ্বে দাস প্রথা, বর্ণবাদ আজ বিলুপ্তির পথে বলা যায়। এই জাতের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা যা দরকার তা তাদের নেই। জাতের বড়াইয়ে মানুষ হলেও যাযাবর বাইদ্যা (বেদে) বলে গণ্য গাঁও- গ্রামে।
পাশাপাশি এই পরিবারের ছেলে-মেয়ে অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে।
নুর মিয়া সরদার জানায়, দু’বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারলেই আমরা মহাখুশি। স্বামীর, স্ত্রী সাংসারিক জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়াই গাঁও-গ্রামে। কপালের টিপ, চুড়ি, থালা-বাসন বিক্রি ও সাপ খেলা ও বানরের নাচ দেখিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে সংসার জীবন চলে।
তারা বলেন, বেঁচে থাকার নাম সংগ্রাম। আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না, আমরা যাযাবর এটাই লোকমুখে আখ্যায়িত। স্বামী-স্ত্রী যখন জীবিকার সন্ধানে ছুটে যান তখন শিশু-ছেলে-মেয়েরা পাখির মতো বন্দিশালার দৃশ্য অবাক হওয়ার মতো। কিভাবে পথ পানে চেয়ে থাকে।
মা-বাবার স্নেহ কখন মিলবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় এই সোনামণিদের। তীব্র গরমে রাতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিক পাখা ব্যবহার করলেও দিনের গরমে সীমাহীন ভোগান্তি, অনাদর অবহেলায় রোগ ব্যাধিতে নিঃশেষ হয়ে যায়। এদের পাশে থাকে না সমাজের কোনো ধনী শ্রেণি, থাকে না প্রশাসনের দৃষ্টি।
এই বেদে পরিবারের শিশুরা সব সময় পুষ্টিহীনতায় ভোগে। সব এলাকায় যাওয়া হলেও সচেতনতার জন্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মী এবং এনজিও কর্মীরা তাদের প্রতি কতটুকু সহনশীল যা খোঁজ-খবর নেন না বলে জানান ওই পরিবার।
‘ছেলে হোক আর মেয়ে হোক দুটি নয় একটি হলে ভালো হয়’ সরকারের স্লোগান। না নেয়ার কারণে প্রতি পরিবারে ৪/৫ জনের মতো সন্তান জন্মায়। তাদের সন্তানরা অন্য ৮-১০ জনের মতো লেখাপড়া শেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। তখন হিমশিম খেতে হয় মা-বাবার।
যদি সরকারের সুদৃষ্টি থাকে তাহলে সম্ভব। ওদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রকৃতির লতাপাতা, গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে রোগ নিরাময় করে থাকেন।
বেদেদের নিবন্ধন ও ভোট দেয়া, আইডি কার্ড প্রদান করা মৌলিক অধিকারের শামিল। কেউ কেউ আইডি কার্ড, নিবন্ধন পেয়েছে আবার কেউ কেউ পায়নি। রোকসানা বেগম, তিতাস, আতিকুল ইসলাম, আক্ষেপ করে বলেন, ১০ জনের মতো বেদে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছি। সরকার আমাদের একটু খাস ভূমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিত তাহলে প্রাণে বেঁচে যেতাম।
আপনার মতামত লিখুন :