ছয় দশক ধরে অগণিত শ্রোতা-দর্শককে সুরের মায়ায় বেঁধে রেখেছেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। আজ (১৭ নভেম্বর) তার জন্মদিন। জীবনের ৭১ বসন্ত পার করে আজ ৭২-এ পা রাখলেন তিনি। তবে বয়সটা তার আপন গতিতে পেরিয়ে গেলেও এখনও সুরের জাদু ছড়িয়ে যাচ্ছেন রুনা লায়লা। শুধু কণ্ঠের নয়, এই বয়সেও গায়িকার রূপের দ্যুতি যেন দিন দিন বাড়ছে।
জন্মদিন প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে রুনা লায়লা বলেন, সবার কাছে দোয়া চাই যেন বিধাতা আমাকে, আমার পরিবারের সবাইকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন। আমি যেন আরও সুন্দর সুন্দর গান শ্রোতা-দর্শককে উপহার দিতে পারি। সংগীত জীবনে দীর্ঘ ষাট বছরের চলার পথে মানুষের যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছি, আমি মনে করি সবার দোয়ায় আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।
১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান অধিরাজ্যের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রুনা লায়লা। তার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী এবং মা অনিতা সেন ওরফে আমেনা লায়লা। তিনিও একজন সংগীত শিল্পী ছিলেন। গায়িকার মামা সুবীর সেন ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। রুনা লায়লার যখন আড়াই বছর বয়স তার বাবা রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে যান। সে সূত্রে তার শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে। গায়কার বাবার পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহীতে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘জুগনু’ সিনেমার ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি ভাইয়া কী পেয়ারি’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৬৪ সালের ২৪ জুন সিনেমার গানে পেশাগতভাবে পা রাখেন রুনা লায়লা। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সংগীতের জন্য বিখ্যাত তিনি। তবে বাংলাদেশের বাইরে গজল শিল্পী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তার সুনাম আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই চলচ্চিত্রের গায়িকা হিসাবে কাজ শুরু করেন রুনা লায়লা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় এবং পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের অনেক গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, হিন্দি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচি, পশতু, ফার্সি, আরবি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি, লাতিন ও ইংরেজি ভাষাসহ মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন রুনা লায়লা। পাকিস্তানে তার গান ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
পাকিস্তানের বহু সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেছেন রুনা লায়লা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘হাম দোনো’, ‘রিশতা হ্যায় পেয়ার কা’, ‘কমান্ডার’, ‘আন্দালিব’, ‘নসিব আপনা আপনা’, ‘দিল অউর দুনিয়া’, ‘উমরাও জান আদা’, ‘আনমোল’, ‘নাদান’, ‘দিলরুবা’সহ আরও বেশকিছু সিনেমায় গান গেয়েছেন তিনি।
১৯৭০ সালের ২৯ মে মুক্তিপ্রাপ্ত নজরুল ইসলাম পরিচালিত সিনেমা ‘স্বরলিপি’-তে প্রথম বাংলাদেশের সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেন রুনা লায়লা। এ সিনেমার ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম প্লে-ব্যাকেই ব্যাপক সাড়া ফেলেন। বাংলাদেশের সিনেমার গানেও তার কণ্ঠের কদর বেড়ে যায়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসে রুনা লায়লা একে একে ‘জীবন সাথী’, ‘টাকার খেলা’, ‘কাজল রেখা’, ‘রং বেরং’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘সুন্দরী’, ‘দেবদাস’, ‘চাঁদনী’, ‘দোলনা’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’,, ‘অন্ধপ্রেম’, ‘দোলা’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’, ‘পাঙ্কু জামাই’, ‘দুই দুয়ারী’সহ আরও বহু সিনেমায় গান গেয়ে শ্রোতা দর্শককে মুগ্ধ করেছেন তিনি।
বাংলা ভাষায় বহু আধুনিক জনপ্রিয় গানও রয়েছে রুনা লায়লার। এরমধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে— ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘পাখি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে গেলে’, ‘বন্ধু তিনদিন তোর’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’, ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে’, ‘ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছো প্রাণ’সহ ইত্যাদি।
‘দি রেইন’, ‘জাদুর বাঁশি’, ‘অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেবদাস’, ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’, ‘তুমি আসবে বলে’ সিনেমায় গানের জন্য সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান রুনা লায়লা।
আপনার মতামত লিখুন :