সাহেরা জালালী। যার শিক্ষার প্রতি ছিলো অগাধ ভালবাসা ও তার মর্মার্থ সমাজে অনগ্রসর নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে জীবদ্দশায় আজীবন কাজ করে গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসদীতে নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চালিয়ে গেছেন সংগ্রাম। এই কারণে তিনি তৎকালীন সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরী নিয়েছিলেন মেয়েদের স্কুলমুখী করার জন্য।
সাহেরা জালালীর ছোট বোন আমেরিকা প্রবাসী হোসনা জালালী জানান, বড় আপা সাহেরা ২০০৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহুর্তেও শিক্ষার জন্য পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। আমার বড় বোন মরহুমা সাহেরা বেগম জালালী যিনি নারী শিক্ষা ও নারীর অধিকার আদায়ের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রূপসদী বৃন্দাবন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু বছর পর আমার বড় বোন সাহেরা জালালী সর্ব প্রথম মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬৯ সালে। তৎকালে রূপসদী বৃন্দাবন উচ্চ বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা ছিল অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমার বড় বোনকে যখন নবম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে বাবা ইচ্ছা পোষণ করেন, তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তারু মিয়া স্যার এবং স্কুল কমিটি বাধা দেন। তখন বাবা, প্রধান শিক্ষক এবং কমিটির বিপক্ষে অবস্থান করে থানা শিক্ষা অফিসার বরাবর একটি আবেদন করেন। এই আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পরও আমাদের বাবা ফকির শাহ সুলতান আহমেদ জালালীকে এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়।
প্রশ্নটি ছিল নিম্নরূপ
মেয়েরা নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাবালিকা হয়। এই সাবালিকা মেয়ের দায়িত্ব কে নিবে? বাবা উত্তরে বলেছিলেন, মেয়ের দায়িত্ব মেয়ে নিজেই নিবে। যেখানে (তৎকালীন) পূর্ব পাকিস্তানে মেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে সেখানে আমার মেয়ে হাই স্কুল পাশ করতে পারবেনা কেন? মেয়ে নয় সন্তান জন্ম দিয়েছি আমি, তাই সন্তানের মঙ্গল কামনাও আমার দায়িত্ব। আপনাদের ধারণা মতে মেয়ে স্কুল থেকে কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাবে এইতো? এখানে আমার কোন আপত্তি নাই, কারণ সাবালিকা মেয়ের দায়িত্ব মেয়েই নিবে। আর যে মেয়ে স্কুল থেকে পালাবে, সে মেয়ে ঘর থেকেও পালাবে। ঘর থেকে পালালে ঘরের চাকর আর পাশের বাড়ীর তাঁতি ছাড়া পুরুষ মানুষ পাবে কোথায়? যদি পালায় তবে স্কুলের ছাত্র অথবা মাস্টারের সাথে পালিয়ে যাক। বাবার এই বলিষ্ঠ বক্তব্যের কাছে প্রধান শিক্ষক এবং কমিটি হার মানে।
১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রূপসদী বৃন্দাবন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ জমাদ্দার বলেন, এই স্কুলে সর্ব প্রথম সাহেরা জালালী সহ আরও ছয়জন মেট্রিক পাশ করেন। সাহেরা শুধু সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছেন, বাকীরা থার্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
সাহেরা জালালীরা দশ ভাই বোন এই রূপসদী বৃন্দাবন থেকে মেট্রিক পরবর্তীতে কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ, এমএ পাশ করে। কাজল জালালী ইতিহাস এবং হোসনা জালালী অর্থনীতিতে সম্মান সহ এমএসএস পাশ করেন।
জালালী পরিবার একটি আদর্শ ও শিক্ষিত পরিবার হিসেবে বাঞ্ছারামপুরে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। তাকে বেগম রোকেয়ার মতো নারী শিক্ষায় আলোর দিশারি বললে ভুল হবে না।
রূপসদীর প্রবীণ ব্যক্তি ও বাঞ্ছারামপুর এসএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুস মিয়া বিএসসি (৮৫) বলেন, সেই যুগে মেয়েরা ছিল গৃহবন্দী। সাবালিকা মেয়েদের অর্থাৎ বারো-চৌদ্দ বছরের মেয়েদের বিয়ে না দিলে পিতা মাতা পাপী বলে গণ্য হতো (তখন বারো-চৌদ্দ বছরের মেয়েদের সাবালিকা ধরা হতো)। সেই অন্ধকার যুগে সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে সাহেরার পিতা ফকির শাহ সুলতান আহমেদ জালালী তার ছয় মেয়েকে বিএ, এমএ পাশ করান। তাদের পরিবার থেকে, এই এলাকা থেকে সাহসী ও মেধাবী ছাত্রী সাহেরা জালালীর হাত ধরে শিক্ষার আলো ছড়াতে শুরু করে। সাহেরা ছিল এ এলাকার প্রথম নারী শিক্ষিকা।
জানা গেছে, মরহুম সাহেরা জালালীর দুই ছেলের একজন কানাডা প্রবাসী, অন্যজন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত।
এলাকাবাসীর মতে, শিক্ষানুরাগী সাহেরা ছিলেন সত্যিকার অর্থে আলোর দিশারী।
আপনার মতামত লিখুন :