Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১
নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়

আর্থিক কেলেঙ্কারিতে শিক্ষকের রেকর্ড 


দৈনিক পরিবার | নাজমুস সাকিব মুন অক্টোবর ১২, ২০২৪, ০৪:৩৪ পিএম আর্থিক কেলেঙ্কারিতে শিক্ষকের রেকর্ড 

গত তিন বছরে বিজ্ঞানাগারে নেওয়া হয়নি কোন নতুন সরঞ্জাম, কম্পিউটার ল্যাব খোলা হয় না নিয়মিত, ব্রডব্যান্ড সংযোগ থাকলেও অকেজো, তালাবদ্ধ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ধুলোয় ধূসর সেখানে নেই সিপিইউ। প্রতি বছর ভর্তির সময় ছাত্রদের থেকে নানা খাতে টাকা নেওয়া হলেও সেসব খাতে নেই দৃশ্যমান কোন ব্যয়। 
সম্প্রতি দেবীগঞ্জ পৌর শহরে অবস্থিত নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এমন অনিয়মের চিত্র সামনে এসেছে। ৫৬০ জন ছাত্রের এই বিদ্যালয়ে অর্থ তছরুপে অভিযোগের তীর বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক ও পূর্বের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলামের দিকে।
দুই একজন শিক্ষক এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও তাদের দেওয়া হয়েছে বদলির হুমকি।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, প্রতি বছর ভর্তির সময় ১৯টি খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকার বেশি নেওয়া হলেও সেগুলো কিভাবে খরচ হচ্ছে তার কোন হদিস নেই।
সরেজমিন বিদ্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রদের সাথে কথা বললে এই তথ্যের সত্যতা মিলে। ভর্তির সময় স্কাউট, কমনরুম, রেড ক্রিসেন্ট, অত্যাবশকীয়, লাইব্রেরী, গবেষণাগার, কৃষি ও বাগান, চিকিৎসা সেবা ও বিবিধ খাতে গত তিন বছরে সাত লাখ টাকা নেওয়া হয়। অথচ এর কোনটির কার্যক্রম চলমান নেই। অত্যাবশকীয় ও কম্পিউটার সেবা খাতে যে টাকা নেওয়া হয় সেগুলো আদৌ কি কি কাজে ব্যয় হয় সে বিষয়টিও ছাত্রদের অজানা। এই খাত দুইটিতে গত ৩ বছরে সাড়ে আট লাখ টাকার বেশি আদায় হলেও এগুলোর ব্যয়ের হিসেবেও নেই স্বচ্ছতা।
এইদিকে টিফিন বাবদ প্রতি মাসে একশত টাকা করে নেওয়া হয়। যদিও বিভিন্ন বন্ধ মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫ মাসই বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকে। সেদিক বিবেচনায় টিফিন খাতে প্রতি বছর ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু এই খাতেও বছর শেষে কোন টাকা থাকে না। ফলে গত ৩ বছরে ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি জুলাই মাসে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাত দিন ক্লাস হলেও ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে ৭৬ হাজার টাকা উত্তোলন করার পাঁয়তারা করেন নূরুল ইসলাম। টিফিন তহবিলের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক স্বপন চন্দ্র রায় প্রামাণিক বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুল স্যার গত জুলাই মাসে ৭৬ হাজার টাকার একটা বিল সাবমিট করেন। প্রধান শিক্ষক আমাদের জিজ্ঞেস করলে আমরা জানাই জুলাই মাসে মাত্র ৪ দিন পরীক্ষা এবং অল্প কয়েকদিন ক্লাস হয়েছিলো তাই এত বেশি বিল হওয়ার কথা না। পরে বিলটি আর পাশ করতে দেওয়া হয়নি।
সরেজমিন বিদ্যালয়টির লাইব্রেরী ঘুরে কোন নতুন বই পাওয়া যায়নি। যে বইগুলো রয়েছে সেগুলোও চার পাঁচ বছরের পুরনো। কম্পিউটার ল্যাবে প্রবেশের সাথে সাথেই সেখানে উপস্থিত দশম শ্রেণীর ছাত্ররা ওয়াইফাই সংযোগ নেই বলে অভিযোগ করে। গত দুই বছরে মাত্র দুইদিন কম্পিউটার ল্যাবে এসেছে বলেও জানায় তারা। বিজ্ঞানাগারে গিয়ে অস্টম শ্রেণির ছাত্রদের দেখা যায়। সেখানকার আলমিরাতে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও সবগুলোই পুরনো ও ধুলোর আস্তরণ জমে আছে। ক্যামিকেলের বোতলের লেবেল নষ্ট হয়ে গেছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছিল দীর্ঘ দিন পর বিজ্ঞানাগারের দরজা খোলা হয়েছে। যদিও সেখানে উপস্থিত সহকারী শিক্ষক স্বপন চন্দ্র রায় প্রামাণিক জানান, নিয়মিতই বিজ্ঞানাগারে ছাত্ররা আসে। তবে মুখ ফসকে কয়েকজন ছাত্র বলেই ফেলে যে গত আট মাসে চলতি সপ্তাহে মাত্র দুই দিন বিজ্ঞানাগারে এসেছে তারা। অথচ সপ্তাহে তিন দিন বিজ্ঞান ক্লাস নেওয়া হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানাগারে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিজ্ঞানাগার প্রায় পরিত্যাক্ত। সাংবাদিকদের দেখাতেই এত আয়োজন! এইদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক জানান, সাংবাদিকরা আসতে পারেন এই চিন্তা করে অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ধার করে কিছু রাসায়নিক আনিয়ে রেখেছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক।
এদিকে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে এই বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সামগ্রী, রাসায়নিক সামগ্রী, শিক্ষা উপকরণ, মনিহারী সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় বাবদ ১৭ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। যার অধিকাংশ টাকা এসব সামগ্রী ক্রয় বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই সবের কিছুই চোখে পড়েনি। এরমধ্যে গত তিন অর্থ বছরে গবেষণাগার সরঞ্জামাদি ক্রয়ে ৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, শিক্ষা ও শিক্ষণ উপকরণ ক্রয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, বইপত্র ও সাময়িকী ক্রয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, কম্পিউটার, কম্পিউটার সামগ্রী, কম্পিউটার ও আনুষাঙ্গিক এই তিন খাতে ২ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, মনিহারী বাবদ দেড় লাখ টাকা, রাসায়নিক বাবদ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। যার পুরোটাই উত্তোলন করে নেওয়া হয়। গত তিন বছরে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৪১ লাখ ৩৬ হাজার টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া কেনাকাটায় কোটেশন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। করা হয়নি ক্রয় সংক্রান্ত কোন কমিটি। ভুয়া বিল ভাউচারে অনুগত ২-১ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর দিয়েই তুলে নেয়া হতো অর্থ।
এতো অভিযোগের পরও তা মানতে নারাজ নূরুল ইসলাম। তিনি জানান, দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি সাধ্যের অতিরিক্ত বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তাকে ফাঁসাতে ষড়যন্ত্র চলছে।
এই বিষয়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, আমার কাছে লিখিত অভিযোগ আসলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন প্রেরণ করব।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.বি.এম রেজাউল করিম বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবো। তদন্ত ছাড়া ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, মো, নূরুল ইসলাম ২০ অক্টোবর ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে অদ্যাবধি দায়িত্বে আছেন। যদিও এই প্রায় পুরো সময়টুকু আলাউদ্দিন আল আজাদ নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসায় নিজের মতো করে স্কুল পরিচালনা করেন নূরুল ইসলাম।

Side banner

শিক্ষা বিভাগের আরো খবর