ঝিকরগাছার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি এমএল মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের টিফিন, পরীক্ষার ফিসসহ বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত ৭৮ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ০৯-০৮-২০২৪ইং তারিখে যশোর জেলা প্রশাসকের নিকট অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে দূর্নীতির এসব অভিযোগ।
বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী সৈকত তাসলিমের ‘মা’ মাশকুরা খাতুন গত ১৭-০৯-২০২৪ইং তারিখে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২৯.৯.৯৮৯ স্মারকে জেলা প্রশাসক মোঃ আজাহারুল ইসলাম বাদীর অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোছাঃ খালেদা খাতুন রেখাকে। তিনি জেলা প্রশাসকের নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অভিযোগের নির্দেশ দেন। তারপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ মাসুমা আখতারকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করে দেন। কমিটির অন্য দুজন হলেন, উপজেলা সিনিয়র মৎস অফিসার এসএম শাহাজান সিরাজ ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ আব্দুস সামাদ।
এদিকে, ঝিকরগাছা সরকারি এমএল মডেল হাইস্কুলের আলোচিত এসব দূর্নীতি অনিয়মের তথ্যানুসন্ধানে এবার বেরিয়ে পড়েছে আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সচেতন অভিভাবক মহলকে হতবাক করেছে।
জানা গেছে বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে অবকাঠামো উন্নয়নখাতে একটি প্রকল্প কাগজে-কলমে সমাপ্ত দেখিয়ে বরাদ্দকৃত সমুদয় টাকা আত্নসাৎ করা হয়েছে। বাস্তবে এই প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, নানাবিধ দূর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে গেলো তিনবছর আগের নেয়া ওই প্রকল্পের কাজ তড়িঘড়ি করে ফের শুরু করেছে। গত রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে এ প্রতিনিধি সরেজমিনে বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিককে কাজ করতে দেখেন। সেখানে ঠিকাদার বা দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। এদিন সকালে অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা দূর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত চলছিল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে এদিন অভিযোগকারী মাশকুরা খাতুনসহ সাতজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক তাদের লিখিত মতামত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের হাতে তুলে দেন।
বাদী মাশকুরা খাতুন দাবি করেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকসহ কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির যোগসাজসে দূর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এক্ষেএে একটি গায়েবী প্রকল্প নতুন করে বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, জেলা প্রশাসক নতুন করে কাজ বন্ধের নির্দেশনা দিলেও তা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের রীতিমত এমন তথ্য সম্মিলিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে অভ্যন্তরীন একটি নিরীক্ষা কমিটি। পাশাপাশি তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ মাসুমা আখতার জানিয়েছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করা হবে।
উল্লেখ্য অতিসম্প্রতি মোটা অংকের এই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে স্কুলের ছাত্র, অভিভাবক ও এলাকাবাসী অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের অপসারণ, বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ফেরানো এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন। ২০১৫ সালে নভেম্বর মাসে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদ দূর্নীতি অনিয়ম ও চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হওয়ায় স্কুলের সুনাম এখন শূন্যের কোঠায় পৌছেছে বলেও যশোর জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে।
এদিকে এসব অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করে অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক। অভ্যন্তরীন নিরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
পরীক্ষা ফিস এবং বোর্ড নির্ধারিত ফিসের অতিরিক্ত নিবন্ধন ফিস বিনা রশিদের মাধ্যমে আদায় করার ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় ঝিকরগাছা সরকারি বহুমুখী মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদকে ঘিরে হৈচৈ শুরু হয়। রীতিমত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে তার সত্যতা মেলে। আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলে প্রধান শিক্ষক অতিরিক্ত আদায় করা টাকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ফেরত দিতে বাধ্য হন। ওই সময় থেকে সকলের নজর পড়ে যায় প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে। এলাকার সচেতন মহল ও অভিভাবকগণ বিদ্যালয়টিতে স্বচ্ছতা আনতে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন। গত আগস্ট মাসে স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে চলে আসে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন খাতের মোটা অংকের টাকা নয়ছয়ের তথ্য।
এক পর্যায়ে গত ১৪ আগস্ট আর্থিক বিষয়সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি নিয়ে প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদের মুখোমুখী হন শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ এলাকার একাট্টা মানুষ। এসময় সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় বিদ্যালয়ের আর্থিক খাত তদন্তের জন্য বিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক সমন্বয়ে একটি অভ্যন্তরীন নিরীক্ষা কমিটি করে দেয়া হয় প্রধান শিককের মধ্যস্থতায়। প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক এ.এফ.এম সাজ্জাদুল আলমকে আহবায়ক ও সহকারী শিক্ষক আমিরুল ইসলাম, আফরোজা খানম ও স্বপন কুমার ঘোষকে ওই কমিটির সদস্য করা হয়।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত স্কুলের আয় ব্যয়ের পূর্নাঙ্গ যাচাই বাছাই করেন। এসময় ঝিকরগাছা সরকারি বহুমুখী মডেল হাইস্কুলের ৭৮ লাখ ৬৫ হাজার ৪শ'৮৭ টাকার আর্থিক অসঙ্গতি পান ওই নিরীক্ষা কমিটি। প্রতিবেদন দাখিলের পর কোনো সরকারি সংস্থার মাধ্যমে উচ্চতর কমিটি গঠন করে পূণঃনিরীক্ষা করা যেতে পারে পূর্ব বলেও ওই কমিটি সদস্যের মত প্রকাশ করেছেন। নিরীক্ষায় উঠে এসেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর আক্ষান ঝড়ের সময় বিদ্যালয়কে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ২০২৪ সালে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে স্কুলের সামনের রাস্তা ও টয়লেট নির্মাণ বাবদ ২০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হলেও সিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়নি। স্কুলটি সরকারি হলেও ৬ষ্ঠ, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৭ম, ৮ম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ১শ'১০টাকা হারে এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে (সাধারণ ও ভোকেশনাল শাখা) মাসিক বেতন ১শ'২০টাকা হারে আদায় করেছেন প্রধান শিক্ষক। এখান থেকে শিক্ষক কর্মচারীগণ কোনো আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করেননি। নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদন থেকে আরও মিলেছে, বিদ্যালয় ম্যাগাজিন তৈরির নামে স্কুলের ব্যাংক একাউন্ট থেকে ৪৩হাজার ১৩৫টাকা তুললেও তা খরচ না করে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩শ' টাকা করে আদায় করে ৩৯ হাজার টাকা খরচ করেছেন মর্মে বিল ভাউচার পাওয়া গেছে। টিফিন বাবদ ব্যাংক থেকে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৬শ'৯৩টাকা, ওঠালেও তার থেকে ২লাখ ৬৩হাজার৩শ' ৮১টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। ভর্তি বাবদ আদায় আদায় করা ৮হাজার টাকা নয়ছয় করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী সরকারি বেতনভূক্ত হলেও প্রধান শিক্ষক তার বেতন বাবদ ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৮হাজার ৪০ টাকা তুলে নিয়েছেন। কমন রুম বানানোর জন্য ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৭শ'৯৩টাকা ওঠালেও বিদ্যালয়ে কোনো কমন রুম নেই। মুদ্রণ খাতে ব্যয়ের জন্য ব্যাংক থেকে ১লাখ ২৬হাজার টাকা তোলা হলেও সেখান থেকে ৫০হাজার টাকার ঘাপলা করা হয়েছে। বিবিধ খাতে খরচ মর্মে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭৯হাজার ৩শ'৮৫টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হলেও সেখানে ১ লাখ ৩ হাজার ৪০টাকা নয়ছয়ের তথ্য পেয়েছেন অভ্যন্তরীন নিরীক্ষা কমিটি। এভাবে ৩১টি খাতে খরচ দেখিয়ে ৭৮লাখ ৬৫হাজার ৪শ'৮৭টাকার আর্থিক অসঙ্গতি করেছেন বলে জোরালো অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
এছাড়া অব্যাহতভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাকগণকে জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়েছে কোনো রশিদ ছাড়াই। ৭০টাকা টিফিন বাবদ আদায় করলেও কোন টিফিন সরবরাহ করা হয় না বলেও শিক্ষার্থীরা তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে। এভাবে বিগত কয়েক বছর জুড়ে বিদ্যালয়ের ৭শ' শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে। নির্দিষ্ট খাতের টাকা নির্দিষ্ট খাতে খরচ না করে করা হয়েছে নয়ছয়। স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীকে বিভিন্ন সময় হয়রানীমূলক একাধিক শো'কজের মাধ্যমে হয়রানী করেছেন। এতে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ চরমভাবে নষ্ট হয়েছে। খাতওয়ারি টাকা আদায় করা হলেও বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নবীন বরণ অনুষ্ঠান হয়না।
অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীদের মৌখিক ও লিখিত অভিযোগের বিষয়েও সত্যতা পেয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার সেহেলী ফেরদৌস। শিক্ষার্থী মাথাপ্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৪শ' টাকা পরীক্ষার ফি বাবদ। বিভাগ, ৩শ'৫০ টাকা এবং বছরের শুর“তেই ১হাজার ৮শ'৯৬টাকা করে এককালীন চার্জ ও গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :