জয়নাল আবেদীন। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভাড়ে ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না। একটি পাকা সেতুর আশায় দেশ স্বাধীনের পর থেকে কেটে গেল ৫৩ বছর। গত দুই বছর আগে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেন পারাপারের জন্য। এর পূর্বে প্রায় ৫১ বছর নৌকা দিয়েই নদী পারাপার হতে হয়েছে। জয়নাল আবেদীন আক্ষেপ নিয়ে বলেন আমি সরকারের কাছে থেকে বয়স্ক ভাতা পাই। সেই বয়স্ক ভাতা বন্ধ করে হলেও আমাদের এই ধলেশ্বরী নদীর উপর একটি পাকা সেতু করে দেয়া হোক। আমাদের অনেক কষ্ট হয়। শেষ জীবনে যেন একটি সেতু দেখে যেতে পাই। বৃদ্ধ জয়নাল আবেদীন আক্ষেপ নিয়ে এমন কথাগুলো বলতে থাকেন। কারণ দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রায় ৫১ বছর শুধু নৌকা দিয়ে পাড় হতে হয়েছে আর গত দুই বছর আগে থেকে বাঁশের সাঁকো। কবে হবে একটি পাকা সেতু। আর কোন অসুস্থ রোগীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে হবে না।
সোমবার (২৮ ডিসেম্বর) ধামরাই উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ফোর্ড নগর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর উপর বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপারের দৃশ্য দেখা যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ফোর্ড নগর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর উপর ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। মালামাল ও মোটরসাইকেল নিয়ে মানুষ পারাপার হতে দেখা যায়। কিন্তু সাঁকোটি নড়বড়ে দেখে বাড়ি মালবাহী যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হয় না। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজও একটি পাকা সেতুর আকাঙ্খায় হাজারো মানুষ। গত দুই বছর আগে মানুষের কষ্ট লাগবে কুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাজী লুৎফর রহমান ও স্থানীয় ইউপি সদস্য উজ্জল মিয়া নিজেদের অর্থায়নে ২ শত মিটার বাঁশের সাঁকোটি নির্মাণ করেন। কিন্তু প্রতিদিন স্কুল, কলেজ, গার্মেন্টসকর্মীসহ লাখো মানুষ অটোরিকশা, মোটরসাইকেল নিয়ে যাতায়াত করায় সেতুটি প্রায় নড়বড়ে হয়ে যায়। এতে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও থাকে। মাঝে মধ্যেই সাঁকোটি মেরামত করতে হয়। মোটরসাইকেল অটোরিকশা নিয়ে সাঁকো পার হলে ১০ টাকা করে দিতে হয়। তবে বেশিরভাগই টাকা না দিয়েই চলে যায়। ওই টাকা দিয়ে সাঁকো মেরামতের কাজ করা হয়ে থাকে। সাঁকোটি ধামরাই, সাভার, মানিক জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার মানুষের একমাত্র যাতায়াতের পথ। এই বাশের সাকো দিয়ে ফোর্ডনগর ফকির পাড়া, খাসিরচর, বহুতকোল, জয়মন্টপ, ধল্লা, গাজিংগা, আড়ালিয়া, ফরিঙ্গা, খরারচর, মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলাসহ প্রায় ২০/২৫ গ্রামের মানুষ যাতায়াত করে। ঢাকার একেবারে সন্নিকটে হওয়া সত্ত্বেও লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া।
স্থানীয়দের দাবী, দেশে আজ উন্নয়নের বাতাস বইতে লাগলেও লাগে নি আমাদের এলাকায়। একটি পাকা সেতুই যেন আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারে। ইট বালু প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে প্রায় ১৫/২০ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়। তাও বাড়ির পাশে আনতে পারি না। গাড়িভাড়া পরে দ্বিগুণ। প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ প্রতিদিন পারাপার হচ্ছে নদী। যার একমাত্র উপায় হচ্ছে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। যাও প্রায় ভেঙে যাওয়ার পথে। পাশেই রয়েছে ফোর্ড নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্ষা মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করে কচিকাঁচা শিক্ষার্থীরা। কখন পানিতে পড়ে যাবে আশঙ্কায় থাকি।
বাঁশের সাঁকো মেরামত করতে আসা শ্রমিক ওমর আলী বলেন, প্রতি মাসেই সাঁকো মেরামত করতে হয়। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, পায়ে চালানো সাইকেল নিয়ে সাঁকোর উপর দিয়ে যাতায়াত করে। এতে সাঁকো নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই মেরামত করা হয়। তা না হলে যে কোন সময় ভেঙে পরতে পারে। তখন ভোগান্তির স্বীকার হতে হবে পথচারীদের।
মাওলানা রহমত উল্লাহ মাদানি বলেন, ধামরাইয়ের শেষ প্রান্তে ঢাকার সন্নিকটে এলাকাটি। দির্ঘ্য দিন ধরে অবহেলিত হয়ে পরে আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় দুই বছর আগে বাঁশের সাঁকোটি নির্মিত হয়েছে। একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া কঠিন বিষয়। মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তাই বাঁশের সাঁকো নয় এখানে একটই পাকা সেতুর প্রয়োজন। এতে মানুষের ভোগান্তি দূর হবে।
কুলসুম বেগম তার প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন ডাক্তারের কাছে নিতে হয়। একবার ছেলের হুইল চেয়ার পাড় করেন পরে আবার অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে আসতে হয়। তাই একটি পাকা সেতু হলে তার মতো হাজারো মানুষকে আর কষ্ট করতে হবে বলে জানান ভুক্তভোগী ওই নারী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো: রাতুল আহমেদ বলেন, আগে পার হতে হতো নৌকা দিয়ে এখন বাঁশের সাঁকো। ভোগান্তি পোহাতেই হচ্ছে। অনেক কষ্ট করে পারাপার হতে হয়। দূরদূরান্তের লোকজন, অসুস্থ রোগী কিংবা ছোট বাচ্চাদের জন্য বাঁশের সাঁকোটি খুবই বিপদজনক। যদি একটি পাকা সেতু হতো মানুষকে আর ভোগান্তির স্বীকার হতে হতো না। ১০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে সাঁকো মেরামতের জন্য চিন্তা করতে হতো না।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বি বলেন, সকালে স্কুলে যাই আবার বিকেলে প্রাইভেট পড়তে যাই সাঁকোর উপর দিয়ে। বাড়িতে সবাই চিন্তা করে। একসাথে অনেক মানুষ সাঁকোর উপর থাকলে মনে হয় ভেঙে পড়বে। তাই সরকারের কাছে দাবী আমাদের যেন একটি পাকা সেতু করে দেন।
ব্যক্তিগত অর্থায়নে গড়ে উঠা বাঁশের সাঁকোই দু'পারের মানুষের ভরসা থাকলেও অর্থের অভাবে বেগ পেতে হচ্ছে সাঁকোটি সংস্কারেও। পথচারীদের পারাপার ফ্রী থাকলেও মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার জন্য ১০ টাকা করে নির্ধারণ করা হলেও টাকা দেন না বেশিরভাগ মানুষ। যে টাকা উঠে তা দিয়েই মাসে দুই বার সাঁকোটি মেরামত করতে হয় বলে জানান সাঁকো থেকে চাঁদা আদায় কারী টিপু মিয়া।
উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ধামরাই উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তের সবচেয়ে অবহেলিত গ্রাম ফোর্ড নগর। এখানে ব্রিজ কবে হবে এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয় প্রতিনিয়ত। সকাল হলেই সবজির গাড়ি আসে।সাঁকো পারাপার হতে পারে না। তারা ১৮/২০ কিলোমিটার ঘুরে বা নৌকায় করে মালামাল নিয়ে যায়। পাশেই ফোর্ড নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তায় থাকে। তাছাড়া অনেকেই বলেন, আমাদের বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতা চাই না, তারপরও একটি ব্রিজ হোক।
এ বিষয়ে কুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাজী লুৎফর রহমান বলেন, আমি উজ্জ্বল মেম্বারকে সাথে নিয়ে মানুষের যাতায়াতের ভোগান্তি কমাতে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে দিয়েছি। এতে আমার অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। আগে এই ঘাট ইজারা নিয়ে অনেকেই ব্যবসা করতো। সেই সুযোগ তাদের আর রইলো না।তবে চেষ্টা চলছে ফোর্ড নগর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর উপর একটি পাকা ব্রিজ হবে। এতে আমার অনেক টাকাও খরচ হয়েছে।
উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তা প্রকৌশলী মিনারুল ইসলাম বলেন, কুল্লা ইউনিয়নের ফোর্ডনগর এলাকাটি অবহেলিত। আমাদের ১৫০ মিটার ব্রিজের একটি প্রকল্প রয়েছে। সেখানে ফোর্ডনগর ব্রিজের নাম দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি আসলেই আমরা ওই এলাকায় নদীর উপর ব্রিজটি করে দিবো। এতে মানুষের ভোগান্তি লাগব হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, কুল্লা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ফোর্ড নগর এলাকায় যে ব্রিজটির কথা এসেছে সেটি জনগুরুত্বপূর্ণ জনগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা মন্ত্রনালয়ে পাঠাবো।
আপনার মতামত লিখুন :