বরগুনার তালতলী উপজেলার পশ্চিম তেঁতুলবাড়িয়া লঞ্চঘাট এলাকায় ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এবং পায়রা নদী ইলিশ রক্ষা কমিটি’র যৌথ উদ্যোগে জাল, জমি, জীবিকা ও জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে একটি জেলে ও কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) বিকাল ৩টায় এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আগামী নভেম্বর ২০২৪ এ আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলনের প্রাক্কালে আয়োজিত এ সমাবেশে স্থানীয় জেলে ও কৃষক জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষক শিল্পায়নের বিরূপ প্রভাব এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ও দাবিসমূহ তুলে ধরেন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ধরা’র উপদেষ্টা ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মাদ খান। সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’র সদস্য সচিব শরীফ জামিল।
সমাবেশে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তালতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) রণজিৎ কুমার, ধরা’র সাংগঠনিক সমন্বয়ক ইবনুল সাঈদ রানা, যমুনা রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক জিয়াউর রহমান, ধরা-পটুয়াখালীর সমন্বয়ক মেজবাহ উদ্দীন মান্নু, গ্লোবাল ল’ থিংকারস সোসাইটি’র প্রেসিডেন্ট রাওমান স্মিতা প্রমূখ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ধরা-তালতলীর সমন্বয়ক আরিফুর রহমান, ধারণা বক্তব্য প্রদান করেন ধরা-পাথরঘাটার সমন্বয়ক শফিকুল ইসলাম খোকন। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন ধরা’র প্রচার সমন্বয়ক মামুন কবীর। সমাবেশটি পরিচালনা করেন ধরা-বরগুনার সমন্বয়ক মুশফিক আরিফ।
সমাবেশে ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন শিল্প প্রকল্পের মাধ্যমে জেলে ও কৃষকদের জীবনমানের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের স্বার্থ রক্ষা না করে উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ও নদী বিনষ্ট করে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ফৌজদারি অপরাধ পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাই কিন্তু মানুষের সমস্যা সমাধানের সময় কোন সরকারের হয় না। আমি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার সময়ে দেশের নদ-নদী, জলাশয় দখলকারীদের তালিকা করেছিলাম। এই দখলের পেছনে কে কে দায়ী তার তালিকাও রয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, পায়রার সৌন্দর্য আমরা দেখি। কিন্তু পায়রা নদীর পাড়ের মানুষের দুঃখ আমরা কতটা জানি? পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সময় তো এলাকাবাসীর সাথে আলোচনা হয়নি। মানুষের সম্মতি ছাড়া কোন উন্নয়ন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই পরিবেশ, নদী ধ্বংসকারী এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে।
শরীফ জামিল তার বক্তব্যে স্থানীয় জনগণের সমস্যা তুলে ধরার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় মানুষদের নিকট থেকে তাদের সমস্যাগুলো শুনতে হবে যাতে আমরা সঠিক সমাধানে যেতে পারি। তিনি তালতলীতে অবৈধ বরিশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, এই কেন্দ্রের কারণে শুধু সামাজিক সংকট নয় পায়রা নদী ও তার বিস্তীর্ণ মোহনায় ইলিশসহ অন্যান্য মৎস সম্পদ বিলীন হতে বসেছে। বাংলাদেশ ও ভারতে একই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের কারণে জেলেদের জাল ধ্বংস নয়, বিদেশী জেলেরাও আমাদের জলসীমা থেকে অন্যায়ভাবে মৎস আহরণ করে আমাদের জেলেদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান।
তালতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) রণজিৎ কুমার লঞ্চ চলাচলের সুনির্দিষ্ট পথ নির্ধারণ এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা আশা করি আমরা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের দাবিগুলো পুরণ করতে পারবো।
ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, দাবি আদায়ের জন্য সকলকে একসাথে দাঁড়াতে হয়। আপনারা আপনাদের সমস্যার সমাধান করতে একত্রিত হয়েছেন। তিনি এলাকার সকলকে তাদের দাবির প্রতি একতাবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
রাওমান স্মিতা বলেন, আপনারা আপনাদের এলাকার জেলে ও কৃষকদের সমস্যার জন্য কাজ করছেন। আজকে প্রতিবাদ জানাতে একত্রিত হয়েছেন। আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা আপনাদের সাথে থাকবো।
এছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পায়রা নদী ইলিশ রক্ষা কমিটির সভাপতি শাহজাহান শেখ, ক্ষতিগ্রস্ত ফাতেমা বেগম, সওদাগরপাড়া কৃষিগ্রামের শাহাদাত মাতুব্বর, ক্ষতিগ্রস্ত সুলতান শিকদার, পালের বালিয়াতলী জেলে সমিতির কাদের মুন্সি, ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাস্টার প্রমূখ।
সমাবেশ থেকে জেলে এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়:
১. উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের সার্বিক উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. নিখোঁজ জেলেদের মৃত/জীবিত সনদ প্রদান এবং তাঁদের পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা ও বিধবা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. সাগরে জেলেদের জন্য জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থাসহ আকাশযান ও প্রযুক্তি সংযোজন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জেলেদের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে।
৪. উপকূলীয় অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নদী ও খালের ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, খনন, স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং বনাঞ্চল রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. জেলেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে অতিরিক্ত ট্রলিং এবং গোপ জাল ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৬. সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. ভারতীয় কারাগারে আটক জেলেদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে।
৮. স্থানীয় সরকার যেমন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং কার্বন নিঃসরণ রোধে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
৯. ভারত ও বাংলাদেশে একই সময় মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
১০. কৃষকের ফসলী জমি নষ্ট করে শিল্প স্থাপন বন্ধ করতে হবে।
১১. নদী ও জলাশয় ভরাট করে স্থাপিত শিল্প কারখানা উচ্ছেদ করতে হবে, শিল্প দূষণ বন্ধ করেত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :