ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একশ্রেণির দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সেবা প্রত্যাশীরা। দলিল লেখক, স্ট্যাম্প ভেণ্ডার ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সাব-রেজিস্ট্রার নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত কয়েক বছর যাবত সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়ে সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন দেখিয়ে, সাব-কবলা দলিলের পরিবর্তে হেবাবিল এওয়াজ, অসিয়ত নামা, ঘোষণাপত্র, আমমোক্তার নামা দলিল রেজিষ্ট্রি করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এমন অভিযোগ সেবা প্রত্যাশীদের।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বর্তমান সাব রেজিস্ট্রার মো. মঞ্জুরুল হাসান। ইতোপূর্বে তিনি সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর তাকে বদলী করা হয়। তিনি বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় যোগদানের অনেক পূর্ব থেকেই দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি দলিল থেকে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ টাকা দলিল লেখক সমিতি, মসজিদ ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসের চাঁদা ছাড়া বাকি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আনুমানিক প্রায় ৫ হাজারের উপর দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ দলিল হেবাবিল এওয়াজ, আমমোক্তার নামা ও দানপত্র ও ঘোষণাপত্র দলিল। এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরের রেজিস্ট্রি করা দলিল পরীক্ষা করলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন অনেকেই।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, দলিলের ফি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করলেও শেরেস্তা (অতিরিক্ত ফি) ছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করেন না। তার চাহিদা মতো টাকা না পেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের অজুহাতে হয়রানি করা হয়। আবার টাকা পেলে সব বৈধ হয়ে যায়। এককথায় বলতে গেলে টাকা ছাড়া কিছুই বুঝে না সাব রেজিস্ট্রার মঞ্জুরুল হাসান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, শেরেস্তা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি তো দূরের কথা সীমাহীন হয়রানির স্বীকার হতে হয় ভুক্তভোগীদের। তাই বাধ্য হয়েই শেরেস্তা (অতিরিক্ত ফি) দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়। তবে কাগজপত্রে ঝামেলা থাকলে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা এমনকি লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রত্যেক দলিল থেকে শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হলেও সিন্ডিকেটের ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না।
সেবাপ্রত্যাশীদের অনেকেই নানাবিধ অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ এবং সিন্ডিকেটের অভিযোগ করলেও নিজেদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল সেবা প্রত্যাশীরা। দলিল লেখক, স্ট্যাম্প ভেন্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সাব-রেজিস্ট্রার মঞ্জুরুল হাসান নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পরও দুর্নীতি মুক্ত হতে পারেনি বাঞ্ছারামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিস। বরং আগের চেয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি দলিল থেকে এখন পাঁচ হাজার টাকা শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও মসজিদের নামে নিচ্ছে ১০০ টাকা, দলিলদাতার আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার সময় অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে আরও ১০০ টাকা। দলিলের নকল তুলতে গেলে সরকারি ফ্রি থেকে অতিরিক্ত দ্বিগুণ টাকা গুণতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
তাদের দাবি, সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়ে সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছেন না বাঞ্ছারামপুর সাব-রেজিস্টার। অফিস টাইমে তার নির্দিষ্ট আসনে না বসে অন্য কক্ষে বসেন তিনি। বাঞ্ছারামপুর উপজেলা দলিল লেখক সমিতিই সাব রেজিস্ট্রারকে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলিল লেখকদের কয়েকজন বর্তমান কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন।
নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার মো. মঞ্জুরুল হাসানের সাথে কথা বলার জন্য তার অফিসে যাওয়ার পর তিনি ব্যস্ত থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :