গাইবান্ধা চরাঞ্চলে দিগন্ত জুড়ে মরিচের ক্ষেত। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে এক দেশ সকল দেশের সেরা। বাংলাদেশের মাটি সোনার চেয়েও খাটি। এই বাংলার মাটিতে দিন রাত পরিশ্রম করে ফসল ফলায় বাংলার কৃষক।বাংলাদেশের উত্তর এর জেলা গাইবান্ধা। স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরী ঘ্রাণ চর অঞ্চলের ভুট্টা মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ।
কৃষি নির্ভর জেলা গাইবান্ধা। এ জেলায় নানা ধরনের ফসলের পাশাপাশি কৃষকরা প্রতি বছরেই মরিচের চাষাবাদ করে থাকে। এবছর গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের পলি ও বেলে-দোআঁশ মাটির উর্বর জমিতে অধিকহারে মরিচের চাষআবাদ হয়েছে। বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে মরিচের সবুজের সমারোহের এ দৃশ্য বিমোহিত করছে সকলকেই। এবছর ফলন ও বেশ ভালো দাম পাওয়ায় আশঙ্কা করছেন চাষিরা। বন্যা হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লেও এ ক্ষতি থেকে ঘুড়ে দাঁড়াতে নব উদ্যমে এগিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ মরিচ চাষিরা।
সরেজমিনে বিভিন্ন মাঠগুলোতে দেখা গেছে মরিচের দৃষ্ঠিনন্দন এ দৃশ্য। মরিচ ক্ষেতে কৃষকের পরিশ্রম আর সঠিক পরিচর্যায় গাছও হয়ে উঠেছে সুস্থ সবল। এখন গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে টকটকে কাঁচা মরিচের বাহার। অনেক গাছে দেখা যাচ্ছে ঝুপড়ি মরিচ ধরায় গাছ হেলে যেতে পড়েছে। এমন দৃশ্য দেখা মরিচ চাষিদের মন ভরে উঠেছে। অল্প খরচে বেশি লাভের আশায় মরিচ ক্ষেতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চাষিরা। দিনের অর্ধেক সময়ে মরিচ তুলে বিকালে বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুতি নেন কৃষকরা। অনেকেই আবার মরিচ তুলে নিয়ে বাড়িতে অথবা জমির আইলেই পাইকারদের কাছে পাইকারি হিসাবে বিক্রি করে থাকেন। চলতি মৌসুমে গাইবান্ধা জেলায় ১,৯৬৭ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ করা হয়। মরিচ চাষে কিভাবে ফলন বৃদ্ধি করা যায় এবং চাষিরা বেশি লাভবান হবেন এদিক নিয়ে গাইবান্ধার বিভিন্ন ব্লকের মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়োজিত আছেন, তারা সার্বক্ষনিক কৃষকদেরকে পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছেন। কৃষকরা প্রকৃত পরামর্শানুযায়ী জমিতে ভাল ফলন পেতে শুরু করেছে।গাইবান্ধার শতাধিক চরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ করা হয়েছে। এসব চরের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে মরিচ যেন কৃষকের প্রাণ। এ বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার অধিক শুকনো মরিচ বিক্রির আশা করছেন কৃষকরা।
প্রতিবছর গাইবান্ধার ফুলছড়ির হাট জমে ওঠে শুকনো মরিচ বেচা-কেনায়। এসিআই, প্রাণ কোম্পানিসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যান লাল মরিচ। এখানে প্রতিমণ শুকনো মরিচ ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা বিক্রি হয় বলে জানান কৃষকরা।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানতে পারি গাইবান্ধার সাতটি উপজেলার মধ্যে মরিচ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকরা। এ উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬৩ হেক্টর মরিচ আবাদ হয়েছে। এছাড়া সাঘাটায় ৪০১, সাদুল্লাপুরে ১৮৫, সুন্দরগঞ্জে ১৫৪, গোবিন্দগঞ্জে ১২৪, পলাশবাড়ীতে ৫১ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৪৭ হেক্টর মরিচ আবাদ করা হয়েছে। এ সবের মধ্যে অধিকাংশ আবাদ রয়েছে চরাঞ্চলে। এ থেকে ৪ হাজার ৩০০ মেট্রিকটন শুকনো মরিচ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানায়, চরাঞ্চলের বেলে মাটিতে ভুট্টা, মরিচ, বাদাম, পাটসহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে মরিচ হচ্ছে কৃষকদের স্বপ্নের ফসল। যা দিয়ে পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হয়। যার কারণে কয়েক বছর ধরে মরিচ উৎপাদনে ঝুঁকছে এখানকার কৃষক। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। গত বছরের তুলনায় আরো এবার বেশি জমিতে মরিচ আবাদ করা হয়েছে।ফুলছড়ি হাটে কয়েকজন ব্যবসায়ী সাথে কথা হলে তারা জানান এ বছর মরিচের চাহিদা অনেক বেশি। এই হাটে মরিচের মান ভালো হওয়া একটু দামও বেশি।
ফুলছড়ির হাট ইজারাদারদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, গাইবান্ধা জেলার বিখ্যাত মরিচের হাট এটি। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে নিরাপদে হাট করেন। আর এখান থেকে সরকার লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করে থাকেন। তবে ফুলছড়ি উপজেলার কয়েকজন কৃষক জানান আমাদের কৃষকের স্বপ্নের ফসল এখন বাস্তবের রূপ নিয়েছে মরিচে। আমরা যখন কাঁচা মরিচ বিক্রি করি তখন সবখানে দাম কমে যায় তাই আমাদের বাধ্য হয়ে মরিচের ডালে লাল মরিচের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, লাল মরিচ শুকিয়ে বিক্রি করলে আমরা ভালো বেনিফিট পাই। কিন্তু সরকার যদি উদ্যোগী হয়ে কাঁচামরিচ তথা কাঁচা সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত তাহলে আমাদের গাইবান্ধার জেলার কৃষক যে স্বপ্ন নিয়ে রোদে পুড়ে দিনরাত পরিশ্রম করে ফসল উৎপন্ন করে তা আরো বেগবান হত এবং ভালো মূল্যায়ন পেলে আমাদের কৃষকরা আরো উজ্জীবিত হতো। এবার সর্বশেষ শারদীয় দুর্গাপূজার সময় গাইবান্ধায় প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম উঠেছিল ৪০০ টাকা। জনজীবনে একটা অস্থির অবস্থা ফেলেছিল।
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ ব্যবসায়ী সহ সুধী মহলের সাথে কথা বলে, বাজার মনিটরিং চলমান রাখায় ও গাইবান্ধার বাজারের শৃঙ্খলা ফেরায় এখন গাইবান্ধায় মরিচের কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় নেমে এসেছে। ইতোমধ্যেই গাইবান্ধা জেলাকে নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন গাইবান্ধা জেলার জেলা প্রশাসক। তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনেক সুধী মহলের পরামর্শে আগামী দিনে ফুলছড়ি বালাসিঘাটের মরিচ সহ কাঁচা সবজি যাতে সংরক্ষণ করা যায় এবং কৃষক কাঁচা সবজিতেই যাতে ভালো মুনাফা পান সে ব্যাপারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ আরও জানান, প্রকৃত কৃষককে তার উৎপাদিত ফসলের প্রকৃত মূল্য দিতে পারলে গাইবান্ধা জেলা হবে আরো সমৃদ্ধশালী জেলা। এবার গাইবান্ধা জেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গাইবান্ধা জেলার কৃষকদের মুখে আনন্দের হাসি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে কৃষকরা সরাসরি বাজারে তাদের কৃষি পণ্য বিক্রি করতে না পারায় মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দামের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা লাভ করেছে। যার ফলে কৃষকের ভিতরে একটা অস্থিরতা অসস্তি কাজ করতো। এখন এটা আর করতে দেয়া হবে না। ব্যবসায়ীরা লাভ করবে। কিন্তু কৃষক যে পণ্য উৎপাদন করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদেরকেই ন্যায্য মূল্য দিতে হবে। এ ব্যাপারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করে।
গাইবান্ধা জেলায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী ছাত্ররা জেলা প্রশাসকের অনুপ্রেরণায় জনতার বাজার নামে একটি বাজার খুলেছেন। সরাসরি কৃষকের কাছে পণ্য কিনে সেই দামে বিক্রি করায় গাইবান্ধার বাজারে ফিরে এসেছে স্বস্তি। এর ফলে সিন্ডিকেট করতে পারছে না মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীগণ। সুফল ভোগ করছেন প্রকৃত কৃষক। স্বস্তিতে জীবন যাপন করছেন গাইবান্ধা জেলার প্রতিদিনের খেটে খাওয়া মানুষসহ নানান পেশাজীবীর মানুষ।
আপনার মতামত লিখুন :